নবম পরিচ্ছেদ : প্রভুভক্তি

এই সময়ে, একবার মাণিকলালের কথা পাড়িতে হইল। মাণিকলাল রাণার নিকট হইতে বিদায় লইয়া প্রথমে সেই পর্ব তগুহায় ফিরিয়া গেল। আর সে দস্যুতা করিবে, এমন বাসনা ছিল না; কিন্তু কর্তুব্যবন্ধুগণ মরিল, কি বাঁচিল, তাহা দেখিবে না কেন? যদি কেহ একেবারে না মরিয়া থাকে, তবে তাহার শুশ্রূষা করিয়া বাঁচাইতে হইবে। এই সকল ভাবিতে ভাবিতে মাণিকলাল গুহাপ্রবেশ করিল।

দেখিল, দুই জন মরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। যে কেবল মূর্ছিিত হইয়াছিল, সে সংজ্ঞালাভ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। মাণিকলাল তখন বিষণ্ণচিত্তে বন হইতে এক রাশি কাঠ ভাঙ্গিয়া আনিল–তদ্দ্বারা দুইটি চিতা রচনা করিয়া, দুইটি মৃতদেহ তদুপরি স্থাপন করিল। গুহা হইতে প্রস্তর ও লৌহ বাহির করিয়া অগ্ন্যুৎপাদনপূর্ব ক চিতায় আগুন দিল। এইরূপ সঙ্গীদিগের অন্তিম সূর্যত করিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া গেল। পরে মনে করিল যে, যে ব্রাহ্মণকে পীড়ন করিয়াছিলাম, তাহার কি অবস্থা হইয়াছে, দেখিয়া আসি। যেখানে অনন্ত মিশ্রকে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল, সেখানে আসিয়া দেখিল যে, সেখানে ব্রাহ্মণ নাই। দেখিল, স্বচ্ছসলিলা পার্বজত্য নদীর জল একটু সমল হইয়াছে–এবং অনেক স্থানে বৃক্ষশাখা, লতা, গুল্ম, তৃণাদি ছিন্নভিন্ন হইয়াছে। এই সকল চিহ্নে মাণিকলাল মনে করিল যে, এখানে বোধ হয়, অনেক লোক আসিয়াছিল। তার পর দেখিল, পাহাড়ের প্রস্তরময় অঙ্গেও কতকগুলি অশ্বের পদচিহ্ন লক্ষ্য করা যায়–বিশেষ অশ্বের ক্ষুরে যেখানে লতা-গুল্ম কাটিয়া গিয়াছে, সেখানে অর্ধাগোলাকৃত চিহ্নসকল স্পষ্ট। মাণিকলাল মনোযোগপূর্বেক বহুক্ষণ ধরিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বুঝিল যে, এখানে অনেকগুলি অশ্বারোহী আসিয়াছিল।

চতুর মাণিকলাল তাহার পর দেখিতে লাগিল, অশ্বারোহিগণ কোন্ দিক হইতে আসিয়াছে–কোন্ দিকে গিয়াছে। দেখিল, কতকগুলি চিহ্নের সম্মুখ দক্ষিণে–কতকগুলির সম্মুখ উত্তরে। কতক দূর মাত্র দক্ষিণে গিয়া চিহ্নসকল আবার উত্তরমুখ হইয়াছে। ইহাতে বুঝিল, অশ্বারোহিগণ উত্তর হইতে এই পর্যগন্ত আসিয়া, আবার উত্তরাংশে প্রত্যাবর্তইন করিয়াছে।

এই সকল সিদ্ধান্ত করিয়া মাণিকলাল গৃহে গেল। সে স্থান হইতে মাণিকলালের গৃহ দুই তিন ক্রোশ। তথায় রন্ধন করিয়া আহারাদি সমাপনান্তে, কন্যাটিকে ক্রোড়ে লইল। তখন মাণিকলাল ঘরে চাবি দিয়া কন্যা ক্রোড়ে নিষ্ক্রান্ত হইল।

মাণিকলালের কেহ ছিল না–কেবল এক পিসীর ননদের জায়ের খুল্লতাতপুত্রী ছিল। সৌজন্যবশত:ই হউক, আর আত্মীয়তার সাধ মিটাইবার জন্যই হউক–মাণিকলাল তাহাকে পিসী বলিয়া ডাকিত।

মাণিকলাল কন্যা লইয়া সেই পিসীর বাড়ী গেল। ডাকিল, “পিসী গা?”

পিসী বলিল, “কি বাছা মাণিকলাল! কি মনে করিয়া?”

মাণিকলাল বলিল, “আমার এই মেয়েটি রাখিতে পার পিসী?”

পি। কতক্ষণের জন্য?

মা। এই দুমাস ছমাসের জন্য?

পি। সে কি বাছা! আমি গরীব মানুষ–মেয়েকে খাওয়াব কোথা হইতে?

মা। কেন পিসী মা, তুমি কিসের গরীব? তুমি কি নাতনীকে দুমাস খাওয়াতে পার না?

পি। সে কি কথা? দুমাস একটা মেয়ে পুষিতে যে এক মোহর পড়ে।

মাণিক। আচ্ছা, আমি সে এক মোহর দিতেছি–তুমি মেয়েটিকে দুমাস রাখ। আমি উদয়পুরে যাইব–সেখানে আমি রাজসরকারে বড় চাকরি পাইয়াছি।