প্রতাপের মুখ প্রফুল্ল হইল। শৈবলিনী তাঁহার মনের কথা বুঝিতে পারিয়া ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “চুপ। এক্ষণে কিছু বলিও না। আমি নিজেই সকল বলিব—কিন্তু তোমার অনুমতিসাপেক্ষ ।”

প্র। আমার অনুমতি কেন?

শৈ। স্বামী যদি আমায় পুনর্বার গ্রহণ করেন, তবে মনের পাপ আবার লুকাইয়া রাখিয়া, তাঁহার প্রণয়ভাগিনী হওয়া কি উচিত হয়?

প্র। কি করিতে চাও?

শৈ। পূর্বকথা সকল তাঁহাকে বলিয়া, ক্ষমা চাহিব।

প্রতাপ চিন্তা করিলেন, বলিলেন, “বলিও! আশীর্বাদ করি, তুমি এবার সুখী হও ।” এই বলিয়া প্রতাপ নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিলেন।

শৈ। আমি সুখী হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই—

প্র। সে কি শৈবলিনী?

শৈ। যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এজন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।

প্রতাপ আর উত্তর করিলেন না। দ্রুতপদে অশ্বারোহণ করিয়া, অশ্বে কশাঘাতপূর্বক সমরক্ষেত্রাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তাঁহার সৈন্যগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল।

গমনকালে চন্দ্রশেখর ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথা যাও?”

প্রতাপ বলিলেন, “যুদ্ধে ।”

চন্দ্রশেখর ব্যগ্রভাবে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “যাইও না। যাইও না। ইংরেজের যুদ্ধে রক্ষা নাই ।”

প্রতাপ বলিলেন, “ফষ্টর এখনও জীবিত আছে, তাহার বধে চলিলাম ।”

চন্দ্রশেখর দ্রুতবেগে আসিয়া প্রতাপের অশ্বের বল্গা ধরিলেন। বলিলেন, “ফষ্টরের বধে কাজ কি ভাই? যে দুষ্ট, ভগবান তাহার দণ্ডবিধান করিবেন। তুমি আমি কি দণ্ডের কর্তা? যে অধম, সেই শত্রুর প্রতিহিংসা করে; যে উত্তম, সে শত্রুকে ক্ষমা করে ।”

প্রতাপ বিস্মিত, পুলকিত হইলেন। এরূপ মহতী উক্তি তিনি কখন লোকমুখে শ্রবণ করেন নাই। অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া, চন্দ্রশেখরের পদধূলি গ্রহণ করিলেন। বলিলেন, “আপনিই মনুষ্যমধ্যে ধন্য। আমি ফষ্টরকে কিছু বলিব না ।”

এই বলিয়া প্রতাপ পুনরপি অশ্বারোহণ করিয়া, যুদ্ধক্ষেত্রাভিমুখে চলিলেন। চন্দ্রশেখর বলিলেন, “প্রতাপ, তবে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যাও কেন?”

প্রতাপ, মুখ ফিরাইয়া অতি কোমল, অতি মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আমার প্রয়োজন

আছে ।” এই বলিয়া অশ্বে কশাঘাত করিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন।

সেই হাসি দেখিয়া, রমানন্দ স্বামী উদ্বিগ্ন হইলেন। চন্দ্রশেখরকে বলিলেন, “তুমি বধূকে লইয়া গৃহে যাও। আমি গঙ্গাস্নানে যাইব। দুই এক দিন পরে সাক্ষাৎ হইবে ।”

চন্দ্রশেখর বলিলেন, “আমি প্রতাপের জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইতেছি ।” রমানন্দ স্বামী বলিলেন, “আমি তাঁহার তত্ত্ব লইয়া যাইতেছি ।”