অষ্টম পরিচ্ছেদ : যুদ্ধক্ষেত্রে
শৈবলিনীকে লইয়া বাহিরে আসিয়া চন্দ্রশেখর দেখিলেন, রমানন্দ স্বামী দাঁড়াইয়া আছেন। স্বামী বলিলেন, “চন্দ্রশেখর! অতঃপর কি করিবে?”

চন্দ্রশেখর বলিলেন, “এক্ষণে, শৈবলিনীর প্রাণরক্ষা করি কি প্রকারে? চারিদিকে গোলা বৃষ্টি হইতেছে। চারিদিক ধূমে অন্ধকার—কোথায় যাইব?”

রমানন্দ স্বামী বলিলেন, “চিন্তা নাই,—দেখিতেছ না, কোন্ দিকে যবনসেনাগণ পলায়ন করিতেছে? যেখানে যুদ্ধারম্ভেই পলায়ন, সেখানে আর রণজয়ের সম্ভাবনা কি? এই ইংরেজ জাতি অতিশয় ভাগ্যবান—এবং কৌশলময় দেখিতেছি—বোধ হয় ইহারা একদিন সমস্ত ভারতবর্ষ অধিকৃত করিবে।চল আমরা পলায়ণপরায়ণ যবনদিগের পশ্চাদ্বর্তী হই। তোমরা আমার জন্য চিন্তা নাই, কিন্তু এই বধুর জন্য চিন্তা।”

তিনজনে পলায়নোদ্যত যবন-সেনার পশ্চাদগামী হইলেন। অকস্মাৎ দেখিলেন, সম্মুখে একদল সুসজ্জিত অস্ত্রধারী হিন্দুসেনা—রণমত্ত হইয়া দৃঢ় পর্বতরন্ধ্র-পথে নির্গত হইয়া ইংরেজরণে সম্মুখীন হইতে যাইতেছে। মধ্যে, তাহাদিগের নায়ক অশ্বারোহণে। সকলেই দেখিয়া চিনিলেন যে, প্রতাপ। চন্দ্রশেখর প্রতাপকে দেখিয়া বিমনা হইলেন। কিঞ্চিৎ পরে বিমনা হইয়া বলিলেন, “প্রতাপ! এ দুর্জয় রণে তুমি কেন? ফের ।”

“আমি আপনাদিগের সন্ধানেই আসিতেছিলাম। চলুন, নির্বিঘ্ন স্থানে আপনাদিগকে রাখিয়া

আসি ।”

এই বলিয়া প্রতাপ, তিনজনকে নিজ ক্ষুদ্র সেনাদলের মধ্যস্থানে স্থাপিত করিয়া ফিরিয়া চলিলেন। তিনি পর্বতমালামধ্যস্থ নির্গমন পথসকল সবিশেষ অবগত ছিলেন। অবিলম্বে তাঁহাদিগকে, সমর-ক্ষেত্র হইতে দূরে লইয়া গেলেন। গমনকালে চন্দ্রশেখরের নিকট, দরবারে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সবিস্তারে শুনিলেন। তৎপরে চন্দ্রশেখর প্রতাপকে বলিলেন, “প্রতাপ, তুমি ধন্য, তুমি যাহা জান, আমিও তাহা জানি ।”

প্রতাপ বিস্মিত হইয়া চন্দ্রশেখরের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

চন্দ্রশেখর বাষ্পগদ্গদ কণ্ঠে বলিলেন, “এক্ষণে জানিলাম যে, ইনি নিষ্পাপ। যদি লোকরঞ্জনার্থ কোন প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, তবে তাহা করিব। করিয়া ইঁহাকে গৃহে লইব। কিন্তু সুখ আর আমার কপালে হইবে না ।”

প্র। কেন, স্বামীর ঔষধে কোন ফল দর্শে নাই?

চ। এ পর্যন্ত নহে।

প্রতাপ বিমর্ষ হইলেন। তাঁহারও চক্ষে জল আসিল। শৈবলিনী অবগুণ্ঠন মধ্য হইতে তাহা দেখিতেছিল—শৈবলিনী একটু সরিয়া গিয়া, হস্তেঙ্গিতের দ্বারা প্রতাপকে ডাকিল—প্রতাপ অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া, তাহার নিকটে গেলেন। শৈবলিনী অন্যের অশ্রাব্য স্বরে প্রতাপকে বলিল, “আমার একটা কথা কাণে কাণে শুনিবে; আমি দূষণীয় কিছুই বলিব না ।”

প্রতাপ বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “তোমার বাতুলতা কি কৃত্রিম?”

শৈ। এক্ষণে বটে। আজি প্রাতে শয্যা হইতে উঠিয়া অবধি সকল কথা বুঝিতে পারিতেছি। আমি কি সত্যসত্যই পাগল হইয়াছিলাম?