সপ্তম পরিচ্ছেদ : দরবারে
বৃহৎ তাম্বুর মধ্যে, বার দিয়া বাঙ্গালার শেষ রাজা বসিয়াছিলেন—শেষ রাজা, কেন না, মীরকাসেমের পর যাঁহারা বাঙ্গালার নবাব নাম ধারণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা কেহ রাজত্ব করেন নাই।

বার দিয়া, মুক্তাপ্রবালরজতকাঞ্চনশোভিত উচ্চাসনে, নবাব কাসেম আলি খাঁ মুক্তাহীরামণ্ডিত হইয়া শিরোদেশে উষ্ণীষোপরে উজ্জ্বলতম সূর্যপ্রভ হীরকখণ্ড রঞ্জিত করিয়া, দরবারে বসিয়াছেন। পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া, ভৃত্যবর্গ যুক্তহস্তে দণ্ডায়মান—অমাত্যবর্গ অনুমতি পাইয়া জানুর দ্বারা ভূমি স্পর্শ করিয়া, নীরবে বসিয়া আছেন। নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বন্দিগণ উপস্থিত?”

মহম্মদ ইর্ফা ন বলিলেন, “সকলেই উপস্থিত ।” নবাব, প্রথমে লরেন্স ফষ্টরকে আনিতে বলিলেন।

লরেন্স ফষ্টর আনীত হইয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

লরেন্স ফষ্টর বুঝিয়াছিলেন যে, এবার নিস্তার নাই। এতকালের পর ভাবিলেন, “এতকাল ইংরেজ নামে কালি দিয়াছি—এক্ষণে ইংরেজের মত মরিব ।”

“আমার নাম লরেন্স ফষ্টর ।”

ন। তুমি কোন্ জাতি?

ফ। ইংরেজ।

ন। ইংরেজ আমার শত্রু—তুমি শত্রু হইয়া আমার শিবিরে কেন আসিয়াছিলে?

ফ। আসিয়াছিলাম, সেজন্য আপনার যাহা অভিরুচি হয়, করুন—আমি আপনার হাতে পড়িয়াছি। কেন আসিয়াছিলাম, তাহা জিজ্ঞাসার প্রয়োজন নাই—জিজ্ঞাসা করিলেও কোন উত্তর পাইবেন না।

নবাব ক্রুদ্ধ না হইয়া হাসিলেন, বলিলেন, “জানিলাম তুমি ভয়শূন্য। সত্য কথা বলিতে পারিবে?”

ফ। ইংরেজ কখন মিথ্যা কথা বলে না।

ন। বটে? তবে দেখা যাউক। কে বলিয়াছিল যে, চন্দ্রশেখর উপস্থিত আছেন? থাকেন তবে তাঁহাকে আন।

মহম্মদ ইর্ফা ন চন্দ্রশেখরকে আনিলেন। নবাব চন্দ্রশেখরকে দেখিয়া কহিলেন, “ইঁহাকে চেন?”

ফ। নাম শুনিয়াছি—চিনি না।

ন। ভাল। বাঁদী কুল্সইম কোথায়?

কুল্সবমও আসিল।

নবাব ফষ্টরকে কহিলেন, “এই বাঁদীকে চেন?”

ফ। চিনি।

ন। কে এ?

ফ। আপনার দাসী।

ন। মহম্মদ তকিকে আন।

তখন মহম্মদ ইর্ফা ন, তকি খাঁকে বদ্ধাবস্থায় আনীত করিলেন।

তকি খাঁ এতদিন ইতস্ততঃ করিতেছিলেন, কোন্ পক্ষে যাই; এই জন্য শত্রুপক্ষে আজিও মিলিতে পারেন নাই। কিন্তু তাহাকে অবিশ্বাসী জানিয়া নবাবের সেনাপতিগণ চক্ষে চক্ষে রাখিয়াছিলেন। আলি হিব্রাহিম খাঁ অনায়াসে তাঁহাকে বাঁধিয়া আনিয়াছিলেন।

নবাব তকি খাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া বলিলেন, “কুল্সপম! বল, তুমি মুঙ্গের হইতে কি প্রকারে কলিকাতায় গিয়াছিলেন?”