তৃতীয় পাঠ
প্রাঞ্জলতা

প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যাহা লিখিবে, লোকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা। কিন্তু অনেক লেখক এ কথা মনে রাখেন না। কতকগুলি নিয়ম, আর কতকগুলি কৌশল মনে রাখিলে রচনা খুব প্রাঞ্জল করা যায়। দুই রকমই বলিয়া দিতেছি।

১। একটি বস্তুর অনেকগুলি নাম থাকিতে পারে, যেমন আগুনের নাম অগ্নি, হুতাশন অথবা হুতভুক্, অনল, বৈশ্বানর, বায়ুসখা ইত্যাদি। এখন, আগুনের কথা লিখিতে গেলে ইহার মধ্যে কোন্ নামটি ব্যবহার করিব? যেটি সবাই জানে, অর্থাৎ আগুন বা অগ্নি। যদি বলি, “হুতভুক্ সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র সঞ্চালিত হয়,” তবে অধিকাংশ বাঙ্গালী আমার কথা বুঝিবে না। যদি বলি যে, “অগ্নির সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র চলে” সকলেই বুঝিবে।

২। অনর্থক কতকগুলা সংস্কৃত শব্দ লইয়া সন্ধি সমাসের আড়ম্বর করিও না—অনেকে বুঝিতে পারে না। যদি বলি, “মীনক্ষোভাকুল কুবলয়” তোমরা কেহ কি সহজে বুঝিবে? আর যদি বলি, “মাছের তাড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে,” তবে কে না বুঝিবে?

৩। অনর্থক কথা বাড়াইও না। অল্প কথায় কাজ হইলে, বেশী কথার প্রয়োজন কি? “এবম্বিধ বিবিধ প্রকার ভয়াবহ ব্যাপারের বশীভূত হইয়া, যখন সূর্যদেব পূর্বগগনে অধিষ্ঠান করিয়া পৃথিবীতে স্বীয় কিরণমালা প্রেরণ করিলেন, তখন আমি সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্বক অন্যত্র গমন করিলাম।” এরূপ না বলিয়া যদি বলি, “এইরূপ অনেক বিষয়ে ভয় পাইয়া, যখন সূর্য উঠিল তখন আমি সেস্থান হইতে চলিয়া গেলাম” তবে অর্থের কোন ক্ষতি হয় না, অথচ সকলে সহজে বুঝিতে পারে।

৪। জটিল বাক্য রচনা করিও না। অনেকগুলি বাক্য একত্র জড়িত করা হইলে বাক্য জটিল হয়। যেখানে বাক্য জটিল হইয়া আসিবে, সেখানে জটিল বাক্যটি ভাঙ্গিয়া ছোট ছোট সরল বাক্যে সাজাইবে। উদাহরণ দেখঃ—

“দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে পল্লীগ্রাম যে জলহীন হইবে, এবং তদ্ধেতুক যে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে, এরূপ অনুমান করিয়াও অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি তাহার প্রতিবিধানে যত্ন করেন না, দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

এই বাক্য অতি জটিল। সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু ছোট ছোট বাক্যে ইহাকে বিভক্ত করিয়া লইলে কত সহজ হয় দেখ। “দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে। যেরূপ শোচনীয় অবস্থায় দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে অনেক পল্লীগ্রাম জলহীন হইবে। পল্লীগ্রাম সকল জলহীন হইলে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে। অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি ইহা অনুমান করিয়াছেন। কিন্তু অনুমান করিয়াও তাঁহারা ইহার প্রতিবিধানের যত্ন করেন না। ইহা দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

একটি বাক্যের স্থানে ছয়টি হইয়াছে। কিন্তু বুঝিবার আর কোন কষ্ট নাই।

৫। উদাহরণ। যেখানে স্থূল কথাটা বুঝিতে কঠিন, সেখানে উদাহরণ প্রয়োগে বড় পরিষ্কার হয়। এই গ্রন্থে সকল কথার উদাহরণ দেওয়া গিয়াছে, সুতরাং উদাহরণের আর পৃথক্ উদাহরণ দিবার প্রয়োজন নাই।

৬। সম্প্রসারণ। স্থূল বাক্যটি বড় সংক্ষিপ্ত হইলে অনেক সময়ে বুঝিবার কষ্ট হয়। এমন স্থলে সম্প্রসারণ করিবে। অশ্বের উদাহরণ পূর্বে প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে দিয়াছি; তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।