যাহাকে সম্পূর্ণ কাব্য বলিয়াছি, এ গ্রন্থ তাহার মধ্যে গণ্য নহে। যিনি মনুষ্যের শক্তি, মনুষ্যের মহত্ত্ব,—সুখের উচ্ছ্বাস, দুঃখের অন্ধকার দেখিতে চাহেন, তিনি এ গ্রন্থে পাইবেন না। যিনি মনুষ্যের ক্ষুদ্রতা, নীচশয়তা, স্বার্থপরতা, এবং বুদ্ধির বৈপরীত্য দেখিতে চাহেন, তিনি ইহাতে যথেষ্ট পাইবেন। যিনি তমোভিভূত ভীরু, নির্বোধ, ভণ্ড, ইন্দ্রিয়পরবশ আধুনিক যুবা দেখিতে চাহেন, তিনি নরেন্দ্রনাথকে দেখিবেন। যিনি শঠ, বঞ্চক, লুব্ধ, অপরিণামদর্শী, বাচাল, “চালাকদাস” দেখিতে চাহেন, তিনি রামদাসকে দেখিবেন। যে সকল বন্য জন্তুগণ অনতিপূর্বকালে সাহেবের কাছে নথি পড়িয়া অর্থ ও মেদ সঞ্চয় করিত, কালিনাথ ধরে, তাহারা জাজ্বল্যমান; এবং ধরপত্নী গৃহিণীর চূড়া। গবেশচন্দ্র নায়কের চূড়া। তাঁহার মত সুদক্ষ, অস্বার্থপর মনুষ্যরত্নের পরিচয়—পাঠক স্বয়ং লইবেন।

এই সকল চিত্র প্রকৃতিমূলক—কিন্তু তাহাদিগের কার্য আত্যন্তিকতাবিশিষ্ট। যে যাহাতে উপহাসের বিষয়, রহস্যলেখক তাহার সেই প্রবৃত্তিঘটিত কার্যকে আত্যন্তিক বৃদ্ধি দিয়া চিত্রিত করেন। এ আত্যন্তিকতা দোষ নহে—এটি লেখকের কৌশল। এই গ্রন্থে বিবৃত সকল কার্যই আত্যন্তিকতাবিশিষ্ট। গ্রন্থে এমন কিছুই নাই যে, আত্যন্তকতাবিশিষ্ট নহে।

মনুষ্যহৃদয়ের যে সকল সৎবৃত্তি, গ্রন্থকার তাহা গ্রন্থমধ্যে একেবারে প্রবেশ করিতে দেন নাই। মধুসূদন ভ্রাতৃবৎসল, এবং নিতান্ত নিরীহ—তদ্ভিন্ন গ্রন্থোক্ত নায়ক নায়িকার কাহারও কোন সদ্‌গুণ নাই। মনুষ্যহৃদয়ের সদ্‌গুণের পরিচয়ও লেখকের অভিপ্রেত নহে। যাহা তাঁহার অভিপ্রেত তাহাতে তিনি সিদ্ধকাম হইয়াছেন বলিতে হইবে।

গল্পটি অতি সামান্য; সহজে বলিতে ছত্র দুই লাগে। আলালের ঘরের দুলাল ইহা অপেক্ষা বৈচিত্রবিশিষ্ট। আর আলালের ঘরের দুলাল উচ্চনীতির আধার—ইহা সেরূপ নহে। আলালের ঘরের দুলালের উদ্দেশ্য নীতি; কল্পতরুর উদ্দেশ্য ব্যঙ্গ। আলালের ঘরের দুলালের লেখক মনুষ্যের দুষ্প্রবৃত্তি দেখিয়া কাতর, ইনি মনুষ্যচরিত্র দেখিয়া ঘৃণাযুক্ত। কল্পতরুর অপেক্ষা আলালের ঘরের দুলালের সম্পূর্ণতা এবং উচ্চাশয়তা আছে।

যে গ্রন্থের আমরা এত প্রশংসা করিলাম, তাহা হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিয়া, লেখকের লিপিপ্রণালীর পরিচয় দিব। যে অংশ উদ্ধৃত করিলাম, গ্রন্থকার তাহাতে একটু বীভৎস রসের অন্যায় অবতারণা করিয়াছেন, এটি রুচির দোষ বটে। ভরসা করি অন্যান্য গুণে প্রীত হইয়া পাঠক তাহাকে মার্জনা করিবেন।

“মধুসূদন খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ, কৃশ, এবং তাহার চুল কাফ্‌রির মত, এই অপরাধে নরেন্দ্রনাথ তাহাকে বিশেষ ভালবাসিতে পারিতেন না। এরূপ সহোদরকে বারংবার ‘পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত অগ্রজ মহাশয়’ বলিয়া পত্র লিখিতে ঘৃণা হইত, এই হেতু প্রতিবার বন্ধের পর বাটী হইতে কলিকাতা যাইবার সময়, যত দিন থাকিতে হইবে অনুমান করিয়া, খরচের টাকা একেবারে সঙ্গে লইয়া যাইতেন। পাছে নরেন্দ্রের কোন কষ্ট হইবে, এই ভাবিয়া মধুসূদনও যেমন করিয়া হউক সমস্ত টাকা সংগ্রহ করিয়া দিতেন।

দুমাস আড়াই মাস অন্তরে নরেন্দ্রনাথ বাটীতে নিজদেহের কুশল লিখিতেন। একবার, বহুকাল পত্র না পাইয়া মধুসূদন চিন্তাকুল হন, এবং পিসীর পরামর্শে নরেন্দ্রকে কলিকাতায় দেখিতে যান। নরেন্দ্রনাথ ইঁহাকে দুই দিবসের অধিক বাসায় থাকিতে দেন নাই, এবং বন্ধুবর্গের নিকট জ্যেষ্ঠকে বাটীর সরকার বলিয়া পরিচিত করেন, ইহা আমরা উত্তমরূপ জানি। নরেন্দ্রনাথ সেই অবধি জ্যেষ্ঠের প্রতি অনিবার্য ঘৃণাকে হৃদয়ে লালনপালন করিতে লাগিলেন।