পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
কল্পতরু *
গদ্যোপন্যাসকে সচরাচর আমরা কাব্যই বলিয়া থাকি। কাব্যের বিষয় মনুষ্যচরিত্র। মনুষ্যচরিত্র ঘোরতর বৈচিত্রবিশিষ্ট। মনুষ্য স্বভাবতঃ স্বার্থপর, এবং মনুষ্য স্বভাবতঃ পরদুঃখে দুঃখী এবং পরোপকারী। মনুষ্য পশুবৃত্ত, এবং মনুষ্য দেবতুল্য। সকল মনুষ্যের চরিত্রই এইরূপ বৈচিত্রবিশিষ্ট; এমন কেহ নাই যে, সে একান্ত স্বার্থপর, এবং এমন কেহ নাই যে, সে একান্ত স্বার্থবিস্মৃত পরহিতানুরক্ত; কেহই নিতান্ত পশু নহে, কেহই নিতান্ত দেবতা নহে। এই পশুত্ব ও দেবত্ব, একত্রে, একাধারে, সকল মনুষ্যেই কিয়ৎপরিমাণে আছে; তবে সর্বত্র উভয়ের মাত্রা সমান নহে। কাহারও সদ্গুণের ভাগই অধিক, অসদ্গুণের ভাগ অল্প, সে ব্যক্তিকে আমরা ভাল লোক বলি; যাহার সদ্গুণের ভাগই অল্প, অসদ্গুণের ভাগ অধিক, তাহাকে মন্দ বলি। কিন্তু এইরূপ দ্বিপ্রকৃতিত্ব সকল মনুষ্যেরই আছে; মনুষ্যচরিত্রই দ্বিপ্রাকৃতিক; দুইটি বিসদৃশ ভাগে মনুষ্যহৃদয় বিভক্ত।
কাব্যের বিষয় মনুষ্যচরিত্র; যে বাক্য সম্পূর্ণ, তাহাতে এই দুই ভাগই প্রতিবিম্বিত হইবে। কি গদ্য, কি পদ্য প্রথম শ্রেণীর গ্রন্থ মাত্রেই এইরূপ সম্পূর্ণতাযুক্ত। কিন্তু কোন কোন কবি, এক একভাগ মাত্র গ্রহণ করেন। তাঁহারা যে মনুষ্যের দ্বিপ্রকৃতিত্ব অবগত নহেন, এমত নহে; তবে তাঁহারা বিবেচনা করেন, যে, যেমন একত্রে সমাবিষ্ট মনুষ্যচরিত্রের ভাল মন্দ অধীত এবং পর্যবেক্ষিত করা আবশ্যক, তেমনি উহা পৃথক্ পৃথক্ করিয়া অধীত এবং পর্যবেক্ষিত করাও আবশ্যক। যেমন একটি যুক্তবর্ণের উচ্চারণ শিখিবার পূর্বে যে বর্ণদ্বয়ের যোগে তাহা নিষ্পন্ন হইয়াছে, তত্তৎ উচ্চারণ অগ্রে পৃথক্ পৃথক্ করিয়া শিখা কর্তব্য, তেমনি মনুষ্যচরিত্রের অংশদ্বয়কে বিযুক্ত করিয়া পৃথক্ পৃথক্ অধ্যয়ন করা বিধেয়। এইরূপ বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া কতকগুলি কবি মনুষ্যচরিত্রের অংশমাত্র গ্রহণ করেন। যাঁহারা মহদংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের গ্রন্থের এক বিশিষ্ট উদাহরণ বিক্টর হ্যূগোর গদ্যকাব্যাবলী। যাঁহারা অসদ্ভাব গ্রহণ করেন, তাঁহারা প্রায় রহস্যলেখক। ইঁহাদিগের চূড়ামণি সর্ বণ্টিস্। ইঁহাদিগের গ্রন্থ সকল অতি উৎকৃষ্ট হইলেও, অসম্পূর্ণ কাব্য।
এই সম্প্রদায়ের কেবল দুই জন লেখক বাঙ্গালা ভাষায় সুপরিচিত; প্রথম টেকচাঁদ ঠাকুর; দ্বিতীয় হুতোম পেঁচা লেখক। অদ্য সেই সম্প্রদায়ের তৃতীয় লেখকের পরিচয় দিতেছি।
বাবু ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, একখানি মাত্র গ্রন্থ প্রচার করিয়া, বাঙ্গালায় প্রধান লেখকদিগের মধ্যে স্থান পাইবার যোগ্য বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। রহস্যপটুতায়, মনুষ্যচরিত্রের বহুদর্শিতায়, লিপিচাতুর্যে, ইনি টেকচাঁদ ঠাকুর এবং হুতোমের সমকক্ষ, এবং হুতোম ক্ষমতাশালী হইলেও পরদ্বেষী, পরনিন্দক, সুনীতির শত্রু, এবং বিশুদ্ধ রুচির সঙ্গে মহাসমরে প্রবৃত্ত। ইন্দ্রনাথ বাবু পরদুঃখে কাতর, সুনীতির প্রতিপোষক, এবং তাঁহার গ্রন্থ সুরুচির বিরোধী নহে। তাঁহার যে লিপিকৌশল, রচনাচাতুর্য, তাহা আলালের ঘরের দুলালে নাই—সে বাক্শক্তি নাই। তাঁহার গ্রন্থে রঙ্গদর্শনপ্রিয়তার ঈষৎ, মধুর হাসি ছত্রে ছত্রে প্রভাসিত আছে, অপাঙ্গে যে চতুরের বক্র দৃষ্টিটুকু পদে পদে লক্ষিত হয়, তাহা না হুতোমে, না টেকচাঁদে, দুইয়ের একেও নাই। তাঁহার গ্রন্থ রত্মময়, সর্বস্থানেই মুক্তা প্রবালাদি জ্বলিতেছে। দীনবন্ধু বাবুর মত তিনি উচ্চ হাসি হাসেন না, হুতোমের মত “বেলেল্লাগিরিতে” প্রবৃত্ত হয়েন না, কিন্তু তিলার্ধ রসের বিশ্রাম নাই। সে রসও উগ্র নহে, মধুর, সর্বদা সহনীয়। “কল্পতরু” বঙ্গভাষায় একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ।
* কল্পতরু। শ্রীইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রণীত। কলিকাতা। ক্যানিঙ লাইব্রেরি। ১২৮১।