পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
পূর্ব পূর্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইয়াছে নরেন্দ্রনাথ কলিকাতায় কি কি করিয়া অবশেষে কি রূপে সেই ভয়ঙ্কর রজনীতে তদীয় শ্রীচরণ-দ্বয়কে কষ্ট দিয়াছেন। এই সমস্ত ঘটনার বহুকাল, এমন কি ৪।৫ মাস পূর্ব হইতে নরেন্দ্রনাথ বাটীর কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। ক্রমে অগ্রহায়ণ মাস শেষ হইল, পরীক্ষার কাল উত্তীর্ণ হইয়া গেল, তথাপি নরেন্দ্র বাড়ী আসিলেন না। ক্রমে পৌষ মাঘ মাসও গেল। তখন মধুসূদনের বড়ই ভাবনা হইল। পিসী গৃহকার্য সমাপন করিয়া প্রতিদিন বিকালে কান্না ধরিলেন।
‘একে পিসী, তায় বয়সে বড়’ সুতরাং শঙ্করী ঠাকুরাণীকে আমরা কখন নাম ধরিয়া ডাকিব না। পিসী অথবা পিসীমা বলিয়া থাকিব। হে হৃদয়গ্রাহিপাঠক মহাশয়! যদি আপনার পিসী—আপনাদের ‘পরমারাধ্য পরমপূজনীয়’ পিতামহের চিরবিধবা কন্যা থাকেন, তবেই আমাদের ভক্তির স্বরূপ বুঝিতে সমর্থ হইবেন।
দিন যায়, রাত্রি আইসে; কিন্তু মধুসূদনের ‘ভাই নরেন্দ্র’ বাটী আইসে না। রাত্রি যায় দিন আইসে, কিন্তু পিসীমার ‘নরেন’ ঘরে আইসে না। দিন রাত্রির কেহ নাই, কাজেই তাহারা না চাইতে আইসে, না চাইতে যায়। আমাদের ‘নরেনের’ পিসী আছেন, সুতরাং তিনি কাঁদিয়াও নরেন্দ্রনাথকে পান না। পাইবেন কেমনে? ছেলের যখন ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে, তখন বাপ মায় পান না, তার, পিসী কোন্ ছার?
মধুসূদন পিসীমার অনুরোধে তাঁহাদের গ্রামের গদিয়ান বাবুকে নরেন্দ্রনাথের সংবাদ জানিবার জন্য একখানি সজলনয়ন পত্র কলিকাতায় লিখিলেন। উত্তর আসিল যে অগ্রহায়ণ মাস অবধি গদিয়ান বাবু নরেন্দ্রনাথের কোন সমাচার পান নাই।
তখন বাড়ীতে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। পিসীমার নাকঝাড়াতে উঠান সর্বদা সপ্ সপ্ করিতে লগিল; ঘরের মিষ্টান্ন পর্যন্ত পিসীমার চক্ষের জলে লোণা হইতে লাগিল। শোকসন্তপ্তা পিসী সর্বদাই নাক ঝাড়িতে আরম্ভ করিলে, প্রতিবেশিনীরাও তাঁহার বাড়ী যাওয়া পরিত্যাগ করিল।
পিসী মধুসূদনকে কলিকাতায় নরেন্দ্রের সন্ধান করিতে যাইবার জন্য বলিলেন। মধু একবার মাত্র কলিকাতায় গিয়াছিলেন; তখন গবেশ রায় সঙ্গে ছিল। এখন গবেশ বিদেশ গিয়াছেন; সুতরাং কলিকাতার গলির ভয়ে, বিনা গবেশ রায়ে, মধুসূদনের যাওয়া ঘটিল না।
একদিন রাত্রি—প্রভাতে পিসীমা ভারি মুখভার করিয়া শয্যা হইতে উঠিলেন, এবং গুণ্ গুণ্ স্বরে গৃহকার্য আরম্ভ করিলেন। কাজ সারা হইলে স্নানে যাইবার জন্য তেলের বাটি গামছা লইয়া ঘর হইতে বাহির হইলেন; কিন্তু যাইতে পারিলেন না। পরচালায়, বাম হস্ত ভূমিতে পাতিয়া দুই পা ছড়াইয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন।
গ্রামের উত্তর পাড়ায় একটি স্ত্রীলোক পরম্পরায় শুনিতে পাইল যে, মধুর পিসী কাঁদিতেছেন। ইহার একটু কবিকল্পনা ছিল; পাড়াগাঁয়ে অনেক স্ত্রীলোকেরই থাকে। ‘ঘটকদের নরেন্দ্র কাল্ রেতে বাড়ী এসেছিল, সকাল বেলা তারে সাপে খেয়েছে, তাই তার পিসী কেঁদে গাঁ মাথায় করেছে’ যাহাকে দেখে এই কথা বলিতে সে ঘটকবাড়ী অভিমুখে চলিল। যখন পঁহুছিল, তখন বাড়ী লোকারণ্য; বোধ হয় যেন ব্রহ্মাণ্ডে আর স্ত্রীলোক নাই। সকলেই বলিতেছে ‘অমন ছেলে হয় না, হবে না।’ ইহার মধ্যে কেহ আর এক জনের নিকট ‘সুদের পয়সা কটা’ চাহিতেছে। পিসীর দিকে যেই মুখ ফিরায়, অমনি তাহার চক্ষু ছলছল, কে যেন লঙ্কা বাটিয়া দেয়; যেই বিমুখ হয়, অমনি ভাবান্তর, যেন ‘পিসীর’ দুঃখের কথা তাহারা শুনেও নাই। কিন্তু পিসীমা এক-চিত্তে এক-ভাবে বসিয়া কেবল চীৎকার করিতেছেন। রোদনের বিরাম নাই, বৈজাত্য নাই। অল্পবয়স্কা একটি স্ত্রীলোক—সেও কাঁদিতে গিয়াছিল—ফিরিয়া যাইবার সময় বলিয়া গেল ‘বেটি বসে কাঁদ্ছে, যেন আলকাৎরা মাখান বড় চরকা ঘুরছে।’