পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
সকলেরই কিছু শুভ ফল আছে, সকলেতেই কিছু অশুভ ফল আছে। শুভাশুভের তারতম্য বিচার করিয়া, কোন্টি কামনীয়, কোন্টি পরিহার্য মনুষ্যে বিচার করে। একটি গেল, তাহার স্থানে আর একটি হইল ; যেটি ছিল, তাহার যে সকল শুভ ফল, তাহা আর রহিল না, কিন্তু যেটি হইল, তাহার জন্য নূতন কতকগুলি শুভ ঘটিবে। এইগুলি যদি পূর্বে শুভের অপেক্ষা গুরুতর হয়, তবে ইহাই বাঞ্ছনীয়। সাকার পূজায় শুভ ফল অনেক থাকিতে পারে, কিন্তু নিরাকার পূজার শুভফল যে তদপেক্ষা গুরুতর নহে, তাহার আলোচনায় শ্রীঃ একেবারে প্রবৃত্ত হয়েন নাই।
যখন এদেশে রেলের গাড়ি ছিল না, তখন ভ্রমণ পদব্রজে, নৌকায়, বা পাল্কীতে করিতে হইত। নৌকা বা পাল্কীতে যাতায়াতের দুই একটি সুফল ছিল—তাহা বাষ্পীয় যানে নাই। নৌকাযাত্রা স্বাস্থ্যকর। যেদেশ দিয়া রেইল গাড়িতে যাও তাহার কিছুই দেখা হয় না, গড়গড় করিয়া তাহা পার হইয়া যাও। পাল্কীতে বা পদব্রজে গেলে, সকল দেশ দেখিয়া যাওয়া যায়; তাহাতে বহুদর্শিতা এবং কৌতূহল নিবারণ লাভ হয়। তাই বলিয়া যে বলিবে রেইলগাড়ি উঠাইয়া দাও, দেশের সর্বনাশ হইতেছে, তাহাকে শ্রীঃ কিরূপ বোদ্ধা বলিয়া গণ্য করিবেন? নিরাকারভক্তও তাঁহাকে সেইরূপ বোদ্ধা বলিয়া মনে করিতে পারে।
তিনি সাকার পূজার গুণ কতকগুলি দেখাইয়াছেন; দোষ একটিও দেখান নাই। তাহার দুই একটি অশুভ ফলের উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় হইতেছে। উল্লেখমাত্র করিব।
প্রথম, সাকার ধর্ম, বিজ্ঞানবিরোধী। যেখানে সাকার ধর্ম প্রচলিত, সেখানে জ্ঞানের উন্নতি হয় না। সেখানে সকল প্রশ্নেরই এক উত্তর—“দেবতায় করেন।” অন্য উত্তরের সন্ধান হয় না। অতএব সাকার পূজা জ্ঞানোন্নতির কণ্টক।
যদি কেহ বলেন যে, অনেকে যুনানী এবং অনেক আর্য পণ্ডিত জ্ঞানের উন্নতি করিয়াছিলেন, তাঁহারাই কি সাকারবাদী ছিলেন না? উত্তর, না—কেহই না। যুনানী তত্ত্বজ্ঞ দার্শনিক এবং বিজ্ঞানবেত্তৃগণ, এবং আর্য মহর্ষিরা, যাঁহারা কিছু জ্ঞানের উন্নতি করিয়াছিলেন, সকলেই নিরাকারবাদী ছিলেন। সাকারবাদী কর্তৃক জ্ঞানের উন্নতি প্রায় দেখা যায় না।
দ্বিতীয়। সাকার পূজা, স্বানুবর্তিতার বিরোধী। চারদিকে মনুষ্যচিত্তকে বাঁধিয়া, মনুষ্য-চরিত্রের স্ফূর্তি, উন্নতি এবং বিস্তৃতি লোপ করে।
তৃতীয়। জ্ঞান এবং স্বানুবর্তিতার গতি রোধ করিয়া, এবং অন্যান্য প্রকারে সাকার পূজা সমাজের গতিরোধ করে।
পক্ষান্তরে, ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, সাকার পূজার একটি গুরুতর সুফল আছে, শ্রীঃ তাহা ধরেন নাই। সাকার পূজা কাব্য এবং সূক্ষ্ম শিল্পের অত্যন্ত পুষ্টিকারক। সাকারবাদীদিগের প্রধান কবিদিগের তুল্য কবি, নিরাকারবাদীদিগের মধ্যে একজন মাত্র আছেন—একা সেক্ষপিয়র। বঙ্গদেশেও, সাকার পূজার ফল, বৈষ্ণব কবিদিগের অপূর্ব গীতিকাব্য।
শ্রীঃ সাকার নিরাকারের মধ্যে কোন্টি প্রকৃত ঈশ্বরোপাসনা তাহার মীমাংসা করেন নাই; আমিও তাহা করিব না। বুঝি বিচার করিতে গেলে, দুয়ের একটিও টিকিবে না। ভক্তিতে কৃষ্ণ পাওয়া যায়, কিন্তু তর্কে কৃষ্ণ বা ঈশ্বর কাহাকেও পাওয়া যায় না। কিন্তু যদি দুইটির মধ্যে একটি প্রকৃত হয়, তবে যেটি প্রকৃত সেইটি প্রচলিত হওয়াই কর্তব্য, অপ্রকৃতের সহস্র শুভ ফল থাকিলেও তাহা প্রচলিত হওয়াই অকর্তব্য। যদি সাকার পূজাই প্রকৃত ঈশ্বরোপাসনা হয়, তবে তৎপ্রদত্ত উপকার সকল এক এক করিয়া গণিবার আবশ্যকতা নাই; তাহাতে কোন উপকার না থাকিলেও, সহস্র অনুপকার থাকিলেও তাহাই অবলম্বনীয়। আর যদি তাহা না হইয়া নিরাকার প্রকৃত ঈশ্বর স্বরূপ হয়, তবে সাকার পূজায়, সহস্র উপকার থাকিলেও, নিরাকার পূজায় কোন ইষ্ট না থাকিলেও, সাকার পূজা লুপ্ত হওয়াই উচিত। ইহার কারণ সত্য ভিন্ন অসত্যে কখন মঙ্গল নাই। সত্যই ধর্ম, সত্যই শুভ, সত্যই বাঞ্ছনীয়, সত্যমেব জয়তি। বঃ—‘ভ্রমর’, অগ্রহায়ণ ১২৮১, পৃ. ১৮১-৮৭।