শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
এই সকল কথা একবার বুঝান হইয়াছে।পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই।
ন কর্ম্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||
ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||
এই কর্ম্মের অনুষ্ঠানই পুরুষ নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হয় না। আর কর্ম্মত্যাগই সিদ্ধি পাওয়া যায় না। ৪।
অর্জ্জুনের প্রশ্ন ছিল, যদি কর্ম্ম হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, তবে কর্ম্মে নিয়োগ করিতেছ কেন? ভগবানের উত্তর, জ্ঞান যদি শ্রেষ্ঠই হয়, তাহা হইলে কি তোমাকে কর্ম্ম ত্যাগ করিতে বলিতে হইবে? জ্ঞাননিষ্ঠ হইলেই কি তুমি কর্ম্ম ত্যাগ করিতে পারিবে? তুমি কোন কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলেই কি নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইবে? না নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইলেই সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে?
কর্ম্মের অনুষ্ঠানে কেন নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইবে না, তাহা ভগবান্ বলিতেছেন,-
ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
কেহই কখনও ক্ষণমাত্র কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পারে না। প্রকৃতিজ গুণে সকলেই কর্ম্ম করিতে বাধ্য হয়। ৫।
হে অর্জ্জুন! তুমি বলিতেছ, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আমি তোমাকে কর্ম্ম করিতে বলিতেছি, কিন্তু কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পার কৈ? প্রকৃতি ছাড়েন কৈ? নিশ্বাস, প্রশ্বাস, অশন, শয়ন, স্নান, পান, এ সকল কর্ম্ম নয় কি? জ্ঞানমার্গাবলম্বী হইলে এ সকল ত্যাগ করা যায় কি?
জিজ্ঞাসু এখানে বলিতে পারেন যে, যে সকল কর্ম্ম প্রকৃতির বশ হইয়া করিতে হইবে তাহা ত্যাগ করা যায় না বটে; কিন্তু যে সকল কার্য্য আপনার ইচ্ছাধীন, তাহা কি জ্ঞানী বা সন্ন্যাসী পরিত্যাগ করিতে পারেন না?
ইহার সহজ উত্তর এই, অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম কেহই পরিত্যাগ করিতে পারে না। ঈশ্বরচিন্তা স্বেচ্ছাধীন কর্ম্ম, ইহা কি জ্ঞানমার্গাবলম্বী পরিত্যাগ করিতে পারে? তবে জ্ঞানের উদ্দেশ্য কি?
অনেকে বলিবেন, সাধারণতঃ যাহাকে কর্ম্ম বলে, তাহার কথা হইতেছে না। হিন্দুশাস্ত্রে শ্রৌত কর্ম্ম ও স্মার্ত্ত কর্ম্মকেই কর্ম্ম বলে। কিন্তু ইহা সত্য নহে, শ্রৌত কর্ম্ম ও স্মার্ত্ত কর্ম্ম না করিয়া কেহ ক্ষণকাল তিষ্ঠিতে পারে না এবং এই সকল স্বাভাবিক নহে যে, প্রকৃতির তাড়নায় বাধ্য হইয়া তাহা করিতে হয়। অতএব সাধারণতঃ যাহাকে কর্ম্ম বলে-যাহা কিছু করা যায়-তাহারই কথা হইতেছে বটে।ইহা আমি পূর্ব্বেও বলিয়াছে, এক্ষণেও বলিতেছি।গীতার ব্যাখ্যায় কর্ম্ম বলিলে, কর্ম্ম মাত্রই বুঝিতে হইবে; কেবল শ্রৌত স্মার্ত্ত কর্ম্ম যে ভগবানের অভিপ্রেত নহে, তাহা এই শ্লোকেই দেখা যাইতেছে।
কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরণ্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||
যে বিমূঢ়াত্মা, মনেতে ইন্দ্রিয়-বিষয় সকল স্মরণ রাখিয়া, কেবল কর্ম্মেন্দ্রিয় সংযত করিয়া অবস্থিতি করে, সে মিথ্যাচারী। ৬।
ভগবান্ বলিয়াছেন যে, কর্ম্মের অননুষ্ঠানেই নৈষ্কর্ম্ম পাওয়া যায় না এবং কর্ম্মত্যাগেই সিদ্ধি পাওয়া যায় না। কর্ম্মের অননুষ্ঠানে যে নৈষ্কর্ম্ম্য ঘটে না, ভগবান্ তাহার এই প্রমাণ দিলেন যে, তুমি কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলেও স্বভাবগুণেই তোমাকে কর্ম্ম করিতে বাধ্য হইতে হইবে। আর কর্ম্মত্যাগেই যে সিদ্ধি ঘটে না, তাহার এই প্রমাণ দিতেছেন যে, কর্ম্মেন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া, “কর্ম্ম করিব না” বলিয়া বসিয়া থাকিলেও ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়সকল মনে আসিয়া উদিত হইতে পারে। তাহা হইলে সে মিথ্যাচার মাত্র। তাহাতে কোন সিদ্ধির সম্ভাবনা নাই।