শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
যদি কর্ম্মত্যাগও করা যায় না, এবং কর্ম্মত্যাগ করিলেও সিদ্ধি নাই, তবে কর্ত্তব্য কি, তাহাই এক্ষণে কথিত হইতেছে।-
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জ্জুন।
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||
হে অর্জ্জুন! যে ইন্দ্রিয়সকল মনের দ্বারা নিয়ত করিয়া, অসক্ত হইয়া কর্ম্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্ম্মযোগের অনুষ্ঠান করে, সেই শ্রেষ্ঠ। ৭।
নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ || ৮ ||
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ || ৮ ||
তুমি নিয়ত কর্ম্ম করিবে। কর্ম্মশূন্যতা হইতে কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ। কর্ম্মশূন্যতায় তোমার শরীরযাত্রাও নির্ব্বাহ হইতে পারে না। ৮।
“তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব!” অর্জ্জুনের এই প্রশ্নের, ভগবান্ এই উত্তর দিলেন। উত্তর এই যে, কর্ম্মত্যাগ কেহই করিতে পারে না, এবং কর্ম্ম ত্যাগ করিলেই সিদ্ধি ঘটে না। কর্ম্ম না করিলে তোমার জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের সম্ভাবনা নাই। অতএব কর্ম্ম করিবে। তবে যদি কর্ম্ম করিতেই হইল, তবে যে প্রকারে করিলে কর্ম্ম মঙ্গলকর হয়, তাহাই করিবে। কর্ম্ম যাহাতে শ্রেয়ঃসাধক হয়, তাহার দুইটি নিয়ম কথিত হইল। প্রথম, ইন্দ্রিয়সকল66 মনের দ্বারা সংযত করিয়া; দ্বিতীয় অনাসক্ত হইয়া কর্ম্ম করিবে। তদতিরিক্ত আর একটি নিয়ম আছে; তাহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং কর্ম্মযোগের কেন্দ্রীভূত। তাহা পরবর্ত্তী শ্লোকে কথিত হইতেছে।
যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোহয়ং লোকোহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||
যজ্ঞার্থ যে কর্ম্ম, তদ্ভিন্ন অন্যত্র কর্ম্ম ইহলোকে বন্ধনের কারণ। হে কৌন্তেয়! তুমি সেই জন্য (যজ্ঞার্থে) অনাসক্ত হইয়া কর্ম্মানুষ্ঠান কর। ৯।
যজ্ঞ শব্দের অর্থের উপর এই শ্লোকের ব্যাখ্যা নির্ভর করে। সচরাচর বেদোক্ত ক্রিয়াকলাপকে পূর্ব্বে যজ্ঞ বলিত, যথা-অশ্বমেধাদি। এক্ষণে সর্ব্বপ্রকার শাস্ত্রোক্ত ক্রিয়াকলাপকেই যজ্ঞ বলে।
প্রাচীন ভাষ্যকার শঙ্কর ও শ্রীধর এ অর্থ গ্রহণ করেন না। শঙ্কর বলেন,-“যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতের্যজ্ঞ ঈশ্বরঃ”। শ্রীধর সেই অর্থ গ্রহণ করেন। মধুসূদন সরস্বতীও এইরূপ অর্থ করেন। রামানুজ তাহা বলেন না। তিনি দ্রব্যার্জনাদিক কর্ম্মকে যজ্ঞ বলেন।
শঙ্করাদি-কথিত যজ্ঞ শব্দের অর্থ এই হয় যে, ঈশ্বরারাধনার্থ যে কর্ম্ম, তাহা ভিন্ন অন্য সকল কর্ম্ম, তাহা কেবল কর্ম্মফল ভোগের জন্য বন্ধন মাত্র। অতএব অনাসক্ত হইয়া কেবল ঈশ্বরোদ্দেশেই কর্ম্ম করিবে।
তাহা হইলে বিচার্য্য শ্লোকের অর্থ এই হয় যে, ঈশ্বরারাধনার্থ যে কর্ম্ম, তাহা ভিন্ন অন্য সকল কর্ম্ম, কর্ম্মফলভোগের বন্ধন মাত্র। অতএব কেবল ঈশ্বরারাধনার্থই কর্ম্ম করিবে।
এ স্থলে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে, তাও কি হয়? ভগবান্ই স্বয়ং বলিতেছেন, নিতান্ত পক্ষে প্রকৃতিতাড়িত হইয়া এবং জীবনযাত্রা নির্ব্বাহার্থও কর্ম্ম করিতে হইবে। ঈশ্বরারাধনা কি সে সকল কর্ম্মের উদ্দেশ্য হইতে পারে? আমি জীবনযাত্রা নির্ব্বাহার্থ স্নান পান, আহার ব্যায়ামাদি করি, তাহাতে ঈশ্বরারাধনার কি সম্বন্ধ থাকিতে পারে?
এ কথা বুঝিবার আগে স্থির করিতে হয়, ঈশ্বরারাধনা কি? মনুষ্যের আরাধনা করিতে গেলে, আমরা আরাধ্য ব্যক্তির স্তবস্তুতি করি। কিন্তু ঈশ্বরকে সেরূপ তোষামোদপ্রিয় ক্ষুদ্রচেতা মনে করা যায় না। তাঁহার স্তবস্তুতি করিলে যদি আমাদের নিজের সুখ, কি চিত্তোন্নতি হয়, তবে এরূপ স্তবস্তুতি করার পক্ষে কোন আপত্তিই নাই, এবং এরূপ স্থলে ইহা অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে প্রকৃত ঈশ্বরারাধনা বলা যায় না। সেইরূপ যাহাকে সাধারণতঃ “যাগযজ্ঞ” বলে, পুষ্প চন্দন, নৈবেদ্য, হোম, বলি, উৎসব, এ সকলও ঈশ্বরারাধনা নহে।
66 ভাষ্যকারেরা বলেন,-কেবল জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল।