শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
মনুষ্যজীবনে যাহা কিছু আছে, পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা তাহা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন;-Thought, Action and Feeling. আমরা না হয় পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতের মতাবলম্বী নাই হইলাম, তথাপি আমরা নিজেই মনুষ্যজীবন আলোচনা করিয়া দেখিলে জানিব যে, তাহাতে এই তিন ভিন্ন আর কিছুই নাই। এই তিনকেই ঈশ্বরমুখ করা যাইতে পারে; তিনিই ঈশ্বরার্পিত হইলে ঈশ্বরসমীপে লইয়া যাইতে পারে। Thought ঈশ্বরমুখ হইলে জ্ঞানযোগ; Action, ঈশ্বরমুখ হইলে কর্ম্মযোগ; Feeling ঈশ্বরমুখ হইলে ভক্তিযোগ। ভক্তিযোগের কথা এখন থাক। ৩৪ শ্লোক পর্য্যন্ত জ্ঞানের কথা ভগবান্ অর্জ্জুনকে বুঝাইলেন; এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের নামই “সাংখ্যযোগ।”51 জ্ঞানে অর্জ্জুনকে উপদিষ্ট করিয়া ভগবান্ এক্ষণে ৩৯ শ্লোক52 হইতে কর্ম্মে উপদিষ্ট করিতেছেন। কি বলিতেছেন, এক্ষণে তাহাই শুন।
ভাষ্যকারেরা বলেন, এই কর্ম্ম, জ্ঞানের সাধন (শ্রীধর) বা প্রাপ্তির উপায় (শঙ্কর)। অর্থাৎ প্রথমে তত্ত্বজ্ঞান কি, তাহা অর্জ্জুনকে বুঝাইয়া, “যদি অর্জ্জুনের তত্ত্বজ্ঞান অপরোক্ষ না হইয়া থাকে, তবে চিত্তশুদ্ধি দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান জন্মিবার নিমিত্ত এই “কর্ম্মযোগ” কহিতেছেন (হিতলাল মিশ্র)। বলা বাহুল্য, এরূপ কথা মূলে এখানে নাই। তবে স্থানান্তরে এরূপ কথা আছে বটে, যথা-
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম্ম কারণমুচ্যতে। ৩।৬
কিন্তু আবার স্থানবিশেষে অন্য প্রকার কথাও পাওয়া যাইবে, যথা-
যৎ সাংখৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্যোগৈরপি গম্যতে।
ইত্যাদি।৫।৬।৫
ইত্যাদি।৫।৬।৫
এ সকল কথার মর্ম্ম পশ্চাৎ বুঝা যাইবে।
এই শ্লোকে কর্ম্মযোগের ফলও কথিত হইতেছে। এই ফল “কর্ম্মবন্ধ” হইতে মোচন। কর্ম্মবন্ধ কি? কর্ম্ম করিলেই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। জন্মান্তরবাদীরা বলেন, এ জন্মে যাহা করা যায়, জন্মান্তরে তাহার ফলভোগ করিতে হয়। যদি আর পুনর্জ্জন্ম না হয়, তবেই আর কর্ম্মফল ভোগ করিতে হইল না। তাহা হইলেই কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি হইল। অতএব মোক্ষপ্রাপ্তই কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি।
কিন্তু যে জন্মান্তর না জানে, সেও কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি এ জীবনের চরমোদ্দেশ্য বলিয়া মানিতে পারে। পরকালে বা জন্মান্তরে কি হইবে, তাহা জানি না, কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে, ইহজন্মেই আমরা সকল কর্ম্মের ফল ভোগ করিয়া থাকি। আমরা সকলেই জানি যে, হিম লাগাইলে ইহজন্মেই সর্দ্দি হয়। আমরা সকলেই জানি যে, রোগের চিকিৎসা করিলে রোগ আরাম হয়। সকলেই জানি যে, আমরা যদি কাহারও শত্রুতা করি, তবে সেও ইহজীবনেই আমাদের শত্রুতা করে, এবং আমরা যদি কাহারও উপকার করি, তবে তাহার ইহজীবনেই আমাদের প্রত্যুপকার করার সম্ভাবনা। সকলেই জানে, ধনসঞ্চয় করিলেই ইহজন্মেই “বড়মানুষী” করা যায়; এবং পরিশ্রম করিয়া অধ্যয়ন করিলেই ইহজন্মেই বিদ্যালাভ করা যায়। সকল প্রকার কর্ম্মের ফল ইহজন্মেই এইরূপ পাওয়া গিয়া থাকে।
51 চতুর্থাধ্যায়ের নাম “জ্ঞানযোগ”। প্রভেদ কি, পশ্চাৎ জানা যাইবে।
52 মধ্যের চারিটি শ্লোক তবে কি প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বোধ হয় না?