বলিতে কেবল বাকি আছে যে, যদিও ৩৭শ শ্লোকে লোক-নিন্দা-ভয় দেখান নাই, তথাপি ইহা স্বার্থবাদ-পরিপূর্ণ। স্বর্গ বা রাজ্যের প্রলোভন দেখাইয়া ধর্ম্মে প্রবৃত্ত করা, আর ছেলেকে মিঠাই দিব বলিয়া সৎকর্ম্মে প্রবৃত্ত করা তুল্য কথা, উভয়ই নিকৃষ্ট স্বার্থপরতার উত্তেজনা মাত্র।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি || ৩৮ ||
অতএব সুখ-দুঃখ লাভালাভ, জয়পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্যুক্ত হও। নচেৎ পাপযুক্ত হইবে।৩৮।
যুদ্ধই যদি স্বধর্ম্ম অতএব অপরিহার্য্য, তবে তাহাতে সুখ দুঃখ, লাভালাভ, জয় পরাজয় সমান জ্ঞান করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করিতে হইবে; কেন না, ফল যাহাই হউক, যাহা অনুষ্ঠেয়, তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য-করিলে সুখ হইবে কি দুঃখ হইবে, লাভ হইবে কি অলাভ হইবে, ইহা বিবেচনা করা কর্ত্তব্য নহে। ইহাই পশ্চাৎ কর্ম্মযোগ বলিয়া কথিত হইয়াছে। যথা-
পাঠক দেখিবেন, ৩৭শ শ্লোকের পর আবার সুর ফিরিয়াছে। এখন যথার্থ ভগবদ্গীতায় মহিমাময় শব্দ পাওয়া যাইতেছে। এই যথার্থ কৃষ্ণের বংশীরব। ৩৪-৩৭শ শ্লোক ও ৩৮শ শ্লোকে কত প্রভেদ!
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্যসি || ৩৯ ||
তোমাকে সাংখ্যে এই জ্ঞান কথিত হইল। (কর্ম্ম)যোগে ইহা (যাহা বলিব) শ্রবণ কর। তদ্দ্বারা যুক্ত হইলে, হে পার্থ! কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্ত হইবে।৩৯।
প্রথম-সাংখ্য কি? “সম্যক্” খ্যায়তে প্রকাশ্যতে বস্তুতত্ত্বমনয়েতি সংখ্যা। সম্যগ্জ্ঞানং তস্যাং প্রকাশমানমাত্মতত্ত্বং সাংখ্যম্।” (শ্রীধর)। যাহার দ্বারা বস্তুতত্ত্ব সম্যক্ প্রকাশিত হয়, তাহা সংখ্যা। তাহার সম্যগ্জ্ঞান প্রকাশমান আত্মতত্ত্ব সাংখ্য। সচরাচর সাংখ্য নামটি এক্ষণে দর্শনবিশেষ সম্বন্ধেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তজ্জন্য ইংরেজ পণ্ডিতেরা গুরুতর ভ্রমে পড়িয়া থাকেন। বস্তুতঃ এই গীতাগ্রন্থে সাংখ্য শব্দ “তত্ত্বজ্ঞান” অর্থেই ব্যবহৃত দেখা যায়, এবং ইহাই ইহার প্রাচীন অর্থ বলিয়া বোধ হয়।
দ্বিতীয়-যোগ কি? যেমন সাংখ্য এক্ষণে কপিল-দর্শনের নাম, যোগও এক্ষণে পাতঞ্জলদর্শনের নাম। পতঞ্জলি যে অর্থে যোগ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন,50 এক্ষণে সচরাচর যোগ করিলে তাহাই আমরা বুঝিয়া থাকি। কিন্তু গীতার যোগ শব্দ সে অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই। তাহা হইলে “কর্ম্মযোগ” “ভক্তিযোগ” ইত্যাদি শব্দের কোন অর্থ হয় না। বস্তুতঃ গীতায় “যোগ” শব্দটি সর্ব্বত্র এক অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে, এমন কথাও বলা যায় না। সচরাচর ইহা গীতায় যে অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহাতে বুঝা যায় যে, ঈশ্বরারাধনা বা মোক্ষের বিবিধ উপায় না সাধনাবিশেষই যোগ। জ্ঞান, ঈদৃশ একটি উপায় বা সাধন, কর্ম্ম তাদৃশ উপয়ান্তর, ভক্তি তৃতীয়, ইত্যাদি-এজন্য জ্ঞানযোগ, কর্ম্মযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হইয়া থাকে। সচরাচর এই অর্থ, কিন্তু এ শ্লোকে সে অর্থে ব্যবহৃত হইতেছে না। এ স্থলে “যোগ” অর্থে কর্মযোগ। এই অর্থে “যোগ” “যোগী” “যুক্ত” ইত্যাদি শব্দ গীতায় ব্যবহৃত হইতে দেখিব। স্থানান্তরে “যোগ” শব্দে জ্ঞানযোগাদিও বুঝাইতে দেখা যাইবে।
অতএব এই শ্লোকের দুইটি শব্দ বুঝিলাম-সাংখ্য, জ্ঞান; এবং যোগ, কর্ম্ম। এক্ষণে মনুষ্যপ্রকৃতির কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক।





