শিষ্য। অর্থাৎ যেমন ধর্ম্মশাস্ত্রে বিহিত হইয়াছে যে, গুরুজনে ভক্তি করিবে, কাহারও হিংসা করিবে না, দান করিবে, শাস্ত্রাধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জ্জন করিবে, সেইরূপ আপনার এই ব্যাখ্যানুসারে ইহাও বিহিত হইবে যে, চিত্রবিদ্যা, ভাস্কর্য্য, নৃত্য গীত, বাদ্য, এবং কাব্যের অনুশীলন করিবে?

গুরু। হাঁ। নহিলে মনুষ্যের ধর্ম্মহানি হইবে।

শিষ্য। বুঝিলাম না।

গুরু। বুঝ। জগতে আছে কি?

শিষ্য। যাহা আছে, তাই আছে।

গুরু। তাহাকে কি বলে?

শিষ্য। সৎ।

গুরু। বা সত্য। এখন এই জগৎ ত জড়পিণ্ডের সমষ্টি। জাগতিক বস্তু নানাবিধ, ভিন্নপ্রকৃতি, বিবিধ গুণবিশিষ্ট। ইহার ভিতর কিছু ঐক্য দেখিতে পাও না? বিশৃঙ্খলার মধ্যে কি শৃঙ্খলা দেখিতে পাও না?

শিষ্য। পাই।

গুরু। কিসে দেখ?

শিষ্য। এক অনন্ত অনির্ব্বচনীয় শক্তি-যাহাকে স্পেন্সর Inscrutable Power in Nature বলিয়াছেন; তাহা হইতে সকল জন্মিতেছে, চলিতেছে, নিয়ত উৎপন্ন হইতেছে এবং তাহাতেই সব বিলীন হইতেছে।

গুরু। তাহাকে বিশ্বব্যাপী চৈতন্য বলা যাউক। সেই চৈতন্যরূপিণী যে শক্তি, তাহাকে চিৎশক্তি বলা যাউক। এখন বল দেখি, সতে এই চিতের অবস্থানের ফল কি?

শিষ্য। ফল ত এই মাত্র আপনিই বলিয়াছেন। ফল এই জাগতিক শৃঙ্খলা। অনির্ব্বচনীয় ঐক্য।

গুরু। বিশেষ করিয়া ভাবিয়া বল, জীবের পক্ষে এই অনির্ব্বচনীয় শৃঙ্খলার ফল কি?

শিষ্য। জীবনের উপযোগিতা বা জীবের সুখ।

গুরু। তাহার নাম দাও আনন্দ। এই সচ্চিদানন্দকে জানিলেই জগৎ জানিলাম। কিন্তু জানিব কি প্রকারে? এক একটা ভাবিয়া দেখ। প্রথম, সৎ অর্থাৎ যাহা আছে, সেই অস্তিত্বমাত্র জানিব কি প্রকারে?

শিষ্য। এই “সৎ” অর্থে সতের গুণও বটে?

গুরু। হাঁ; কেন না, সেই সকল গুণও আছে। তাহাই সত্য।

শিষ্য। তবে সৎ বা সত্যকে প্রমাণের দ্বারা জানিতে হইবে।

গুরু। প্রমাণ কি?

শিষ্য। প্রত্যক্ষ ও অনুমান। অন্য প্রমাণ আমি অনুমানের মধ্যে ধরি।

গুরু। ঠিক। কিন্তু অনুমানেরও বুনিয়াদ প্রত্যক্ষ। অতএব সত্যজ্ঞান প্রত্যক্ষমূলক।* প্রত্যক্ষ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের দ্বারা হইয়া থাকে। অতএব যথার্থ প্রত্যক্ষ জন্য ইন্দ্রিয়সকলের অর্থাৎ কতিপয় শারীরিক বৃত্তির স্বচ্ছন্দতাই যথেষ্ট। তার পর অনুমান জন্য জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের সমুচিত স্ফূর্ত্তি ও পরণতি আবশ্যক। জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলির মধ্যে কতকগুলিকে হিন্দুদিগের দর্শনশাস্ত্রে মনঃ নাম দেওয়া হইয়াছে, আর কতকগুলি নাম বুদ্ধি বলা হইয়াছে। এই মন ও বুদ্ধির প্রভেদ কোন কোন ইউরোপীয় দার্শনিককৃত জ্ঞাপিকা এবং বিচারিকা বৃত্তি মধ্যে যে প্রভেদ, তাহার সঙ্গে কতক মিলে। অনুমান জন্য এই মনোনামযুক্ত বৃত্তিগুলির স্ফূর্ত্তিই বিশেষ প্রয়োজনীয়। এখন এই সদ্ব্যাপী চিৎকে জানিবে কি প্রকারে?

* সকল জ্ঞান প্রত্যক্ষমূলক নহে, ইহা ভগবদ্গীতার টীকায় বুঝান গিয়াছে-পুনরুক্তি অনাবশ্যক।