সপ্তবিংশতিতম অধ্যায়-চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি

শিষ্য। এক্ষণে অন্যান্য কার্য্যকারিণী বৃত্তির অনুশীলনের পদ্ধতি শুনিতে ইচ্ছা করি।

গুরু। সে সকল বিস্তারিত কথা শিক্ষাতত্ত্বের অন্তর্গত। আমার কাছে তাহা বিশেষ শুনিবার প্রয়োজন নাই। শারীরিকী বৃত্তি বা জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সম্বন্ধেও আমি কেবল সাধারণ অনুশীলনপদ্ধতি বলিয়া দিয়াছি, বৃত্তিবিশেষ সম্বন্ধে অনুশীলনপদ্ধতি কিছু শিখাই নাই। কি প্রকারে শরীরকে বলাধান করিতে হইবে, কি প্রকারে অস্ত্রশিক্ষা বা অস্ত্রসঞ্চালন করিতে হইবে, কি প্রকারে মেধাকে তীক্ষ্ণ করিতে হইবে বা কি প্রকারে বুদ্ধিকে গণিতশাস্ত্রের উপযোগী করিতে হইবে, তাহা বলি নাই। কারণ, সে সকল শিক্ষাতত্ত্বের অন্তর্গত। অনুশীলনতত্ত্বের স্থূল মর্ম্ম বুঝিবার জন্য কেবল সাধারণ বিধি জানিলেই যথেষ্ট হয়। আমি শারীরিকী ও জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সম্বন্ধে তাহাই বলিয়াছি। কার্য্যকারিণী বৃত্তি সম্বন্ধেও সেইরূপ কথা বলাই আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু কার্য্যকারিণী বৃত্তি অনুশীলন সম্বন্ধে যে সাধারণ বিধি, তাহা ভক্তিতত্ত্বের অন্তর্গত। প্রীতি ভক্তির অন্তর্গত, এবং দয়া প্রীতির অন্তর্গত। সমস্ত ধর্ম্মই এই তিনটি বৃত্তির উপর বিশেষ প্রকারে নির্ভর করে। এই জন্য আমি ভক্তি, প্রীতি, দয়া বিশেষ প্রকারে বুঝাইয়াছি। নচেৎ সকল বৃত্তি গণনা করা বা তাহার অনুশীলনপদ্ধতি নির্ব্বাচন করা আমার উদ্দেশ্য নহে, সাধ্যও নহে। শারীরিকী, জ্ঞানার্জ্জনী বা কার্য্যকারিণী বৃত্তি সম্বন্ধে আমার যাহা বক্তব্য, তাহা বলিয়াছি। এক্ষণে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু বলিব।

জগতের সকল ধর্ম্মের একটি অসম্পূর্ণতা এই যে, চিত্তরজ্ঞিনী বৃত্তিগুলির অনুশীলন বিশেষরূপে উপদিষ্ট হয় নাই। কিন্তু তাই বলিয়া কেহ এমত সিদ্ধান্ত করিতে পারে না যে, প্রাচীন ধর্ম্মবেত্তারা ইহার আবশ্যকতা অনবগত ছিলেন বা এ সকলের অনুশীলনের কোন উপায় বিহিত করেন নাই। হিন্দুর পূজার পুষ্প, চন্দন, মাল্য, ধূপ, দীপ, ধুনা, গুগ্‌গুল, নৃত্য, গীত, বাদ্য প্রভৃতি সকলেরই উদ্দেশ্য ভক্তির অনুশীলনের সঙ্গে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলনের সম্মিলন অথবা এই সকলের দ্বারা ভক্তির উদ্দীপন। প্রাচীন গ্রীকদিগের ধর্ম্মে, এবং মধ্যকালের ইউরোপে রোমীয় খ্রীষ্টধর্ম্মে উপাসনার সঙ্গে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিসকলের স্ফূর্ত্তির ও পরিতৃপ্তির বিলক্ষণ চেষ্টা ছিল। আপিলীস্ বা রাফেলের চিত্র, মাইকেল এঞ্জিলো বা ফিদিয়সের ভাস্কর্য্য, জর্ম্মাণির বিখ্যাত সঙ্গীতপ্রণেতৃগণের সঙ্গী উপাসনার সহায় হইয়াছিল। চিত্রকরের, ভাস্করের স্থপতির, সঙ্গীতকারকের সকল বিদ্যা ধর্ম্মের পদে উৎসর্গ করা হইত। ভারতবর্ষেরও স্থাপত্য, ভাস্কর্য্য, চিত্রবিদ্যা, সঙ্গীত উপাসনার সহায়।

শিষ্য। তবে এমন হইতে পারে, প্রতিমা গঠন উপাসনার সঙ্গে এই প্রকার চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির তৃপ্তির আকাঙ্খার ফল।

গুরু। এ কথা সঙ্গত বটে,* কিন্তু প্রতিমাগঠনের যে অন্য কোন মূলও নাই, এমন কথা বলিতে পার না। প্রতিমাপূজার উৎপত্তি কি, তাহা বিচারের স্থূল এ নহে। চিত্রবিদ্যা, ভাস্কর্য্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, এ সকল চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির স্ফূর্ত্তি ও তৃপ্তিবিধায়ক, কিন্তু কাব্যই চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ উপায়। এই কাব্য, গ্রীক ও রোমক ধর্ম্মের সহায়, কিন্তু হিন্দুধর্ম্মেই কাব্যের বিশেষ সাহায্য গৃহীত হইয়াছে। রামায়ণ ও মহাভারতের তুল্য কাব্যগ্রন্থ আর নাই, অথচ ইহাই হিন্দুদিগের এক্ষণে প্রধান ধর্ম্মগ্রন্থ। বিষ্ণু ও ভাগবতাদি পুরাণে এমন কাব্য আছে যে, অন্য দেশে তাহা অতুলনীয়। অতএব হিন্দুধর্ম্মে যে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলনের অল্প মনোযোগ ছিল, এমন নহে। তবে যাহা পূর্ব্বে বিধিবদ্ধ না হইয়া কেবল লোকাচারেই ছিল, তাহা এক্ষণে ধর্ম্মের অংশ বলিয়া যাহা পূর্ব্বে বিধিবদ্ধ না হইয়া কেবল লোকাচারেই ছিল, তাহা এক্ষণে ধর্ম্মের অংশ বলিয়া বিধিবদ্ধ করিতে হইবে। এবং জ্ঞানার্জ্জনী ও কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলির যেমন অনুশীলন অবশ্য কর্ত্তব্য, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির সেইরূপ অনুশীলন ধর্ম্মশাস্ত্রের দ্বারা অনুজ্ঞাত করিতে হইবে।

* এ বিষয়ে পূর্ব্বে যাহা ইংরাজিতে বর্ত্তমান লেখক কর্ত্তৃক লিখিত হইয়াছিল, তাহার কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা যাইতেছে। “The true explanation consists in the ever true relations of the subjective ideal to its objective Reality. Man is by instinct poet and an artist. The passionate yearnings of the heart for the Ideal in beauty, in power, and in purity, must find an expression in the world of the Real. Hence proceed all poetry and all art. Exactly in the same way the ideal of the Divine in man receives a form from him, and the form an image. The existence of Idols is as justifiable as that of the tragedy of Hemlet or of that of Prometheus. The religious worship of Idols is as justifiable as the intellectual worship of Hamlet or Prometheus. The homage we owe to the ideal of the human realized in art is admiration. The homage we owe to the ideal of the Divine realized in idolatry is worship.”-Statesman, Oct. 28, 1882.

এই তত্ত্ব সুলেখক বাবু চন্দ্রনাথ বসু নবজীবনের “ষোড়শোপচারে পূজা” ইত্যাদি শীর্ষক প্রবন্ধে এরূপ বিশদ ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া বুঝাইয়াছেন যে, আমার উপরিধৃত দুই ছাত্র ইংরেজির অনুবাদ এখানে দিবার প্রয়োজন আছে বোধ হয় না।