অষ্টাবিংশতিতম অধ্যায়-উপসংহার

গুরু। অনুশীলনতত্ত্ব সমাপ্ত করিলাম। যাহা বলিবার, তাহা সব বলিয়াছি, এমন নহে। সকল কথা বলিতে হইলে শেষ হয় না। সকল আপত্তির মীমাংসা করিয়াছি এমন নহে; কেন না, তাহা করিতে গেলেও কথার শেষ হয় না। অনেক কথা অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ আছে, এবং অনেক ভুলও যে থাকিতে পারে, তাহা আমার স্বীকার করিতে আপত্তি নাই। আমি এমনও প্রত্যাশা করিতে পারি না যে, আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা সকলই বুঝিয়াছ। তবে ইহা পুনঃ পুনঃ পর্য্যালোচনা করিলে ভবিষ্যতে বুঝিতে পারিবে, এমন ভরসা করি। তবে স্থূল মর্ম্ম যে বুঝিয়াছ, বোধ করি এমন প্রত্যাশা করিতে পারি।

শিষ্য। তাহা আপনাকে বলিতেছি, শ্রবণ করুন।

১। মনুষ্যের কতকগুলি শক্তি আছে। আপনি তাহার বৃত্তি নাম দিয়াছিলেন। সেইগুলির অনুশীলন, প্রস্ফুরণ ও চরিতার্থতায় মনুষ্যত্ব।

২। তাহাই মনুষ্যের ধর্ম্ম।

৩। সেই অনুশীলনের সীমা, পরস্পরের সহিত বৃত্তগুলির সামঞ্জস্য।

৪। তাহাই সুখ।

৫। এই সমস্ত বৃত্তির উপযুক্ত অনুশীলন হইলে ইহারা সকলই ঈশ্বরমুখী হয়। ঈশ্বরমুখতাই উপযুক্ত অনুশীলন। সেই অবস্থাই ভক্তি।

৬। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন; এই জন্য সর্ব্বভূতে প্রীতি, ভক্তির অন্তর্গত, এবং নিতান্ত প্রয়োজনীয় অংশ। সর্ব্বভূতে প্রীতি ব্যতীত ঈশ্বরে ভক্তি নাই, মনুষ্যত্ব নাই, ধর্ম্ম নাই।

৭। আত্মপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বদেশপ্রীতি, পশুপ্রীতি, দয়া, এই প্রীতির অন্তর্গত। ইহার মধ্যে মনুষ্যের অবস্থা বিবেচনা করিয়া, স্বদেশপ্রীতিকেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম বলা উচিত।

এই সকল স্থূল কথা।

গুরু। কই, শারীরিকী বৃত্তি, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি, কার্য্যকারিণী, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি এ সকলের তুমি ত নামও করিলে না?

শিষ্য। নিষ্প্রয়োজন। অনুশীলনতত্ত্বের স্থূল মর্ম্মে এ সকল বিভাগ নাই। এক্ষণে বুঝিয়াছি, আমাকে অনুশীলনতত্ত্ব বুঝাইবার জন্য এ সকল নামের সৃষ্টি করিয়াছেন।

গুরু। তবে, তুমি অনুশীলনতত্ত্ব বুঝিয়াছ। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করি, ঈশ্বরে ভক্তি তোমার দৃঢ় হউক। সকল ধর্ম্মের উপরে স্বদেশপ্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না।*

* অনুশীলনতত্ত্বের সঙ্গে জাতিভেদ ও শ্রমজীবনের কি সম্বন্ধ, তাহা এই গ্রন্থমধ্যে বুঝাইলাম না। কারণ, তাহা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার টীকায় “স্বধর্ম্ম” বুঝাইবার সময়ে বুঝাইয়াছি। গ্রন্থের সম্পূর্ণতা রক্ষার জন্য (ঘ) চিহ্নিত ক্রোড়পত্র তদংশ গীতার টীকা হইতে উদ্ধৃত করিলাম।