দান করিতে হইবে, কিন্তু নিষ্কাম হইয়া দান করিবে। দয়াবৃত্তির অনুশীলন জন্য দান করিবে; দয়াবৃত্তিতে প্রীতিবৃত্তিরই অনুশীলন, এবং প্রীতি ভক্তিরই অনুশীলন; অতএব ভক্তি, প্রীতি, দয়ার অনুশীলন জন্য দান করিবে, বৃত্তির অনুশীলন ও স্ফূর্ত্তিতে ধর্ম্ম, অতএব ধর্ম্মার্থেই দান করিবে, পুণ্যার্থে বা স্বর্গার্থ নহে। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন, অতএব সর্ব্বভূতে দান করিবে, যাহা ঈশ্বরের, তাহা ঈশ্বরকে দেয়, ঈশ্বরে সর্ব্বস্ব দনই মনুষ্যত্বের চরম। সর্ব্বভূতে এবং তোমাতে অভেদ, অতএব তোমার সর্ব্বস্বে তোমার, এবঞ্চ সর্ব্বলোকের অধিকার; যাহার সর্ব্বলোকের, তাহা সর্ব্বলোককে দিবে। ইহাই যথার্থ হিন্দুধর্ম্মের অনুমোদিত, গীতোক্ত ধর্ম্মের অনুমোদিত দান। ইহাই যথার্থ দানধর্ম্ম। নহিলে তোমার অনেক আছে, তুমি ভিক্ষুককে কিছু দিলে, তাহা দান নহে। বিস্ময়ের বিষয়, এমন অনেক লোকও আছে যে, তাহাও দেয় না।

শিষ্য। সকলকেই কি দান করিতে হইবে? দানের কি পাত্রাপাত্র নাই? আকাশের সূর্য্য সর্ব্বত্র করবর্ষণ করেন বটে, কিন্তু অনেক প্রদেশ তাহাতে দগ্ধ হইয়া যায়। আকাশের মেঘ সর্ব্বত্র জলবর্ষণ করেন বটে, কিন্তু তাহাতে অনেক স্থান হাজিয়া ভাসিয়া যায়। বিচারশূন্য দানে কি সেইরূপ আশঙ্কা নাই?

গুরু। দান, দয়াবৃত্তির অনুশীলন জন্য। যে দয়ার পাত্র, তাহাকেই দান করিবে। যে আর্ত্ত, সে-ই দয়ার পাত্র, অপরে নহে। অতএব যে আর্ত্ত, তাহাকে দান করবে-অপরকে নহে। সর্ব্বভূতে দয়া করিবে বলিলে এমন বুঝায়না যে, যাহার কোন প্রকার দুঃখ নাই, তাহার দুঃখমোচনার্থ আত্মোৎসর্গ করিবে। তবে কোন প্রকার দুঃখ নাই, এমন লোকও সংসারে পাওয়া যায় না। যাহার দারিদ্র্যদুঃখ নাই, তাহাতে ধনদান বিধেয় নাই, যাহার রোগদুঃখ নাই, তাহার চিকিৎসা বিধেয় নহে। ইহা বলা কর্ত্তব্য, অনুচিত দানে অনেক সময়ে পৃথিবীর পাপ বৃদ্ধি হয়। অনেক লোক অনুচিত দান করে বলিয়া, পৃথিবীতে যাহারা সৎকার্য্যে দিন যাপন করিতে পারে, তাহারাও ভিক্ষুক বা প্রবঞ্চক হয়। অনুচিত দানে অনেক সময়ে আলস্য, বঞ্চনা, এবং পাপক্রিয়া বৃদ্ধি পাইয়া থাকে, পক্ষান্তরে, অনেকে তাই ভাবিয়া কাহাকেও দান করেন না। তাঁহাদের বিবেচনায় সকল ভিক্ষুকই আলস্যবশতঃই ভিক্ষুক অথবা প্রবঞ্চক। এই দুই দিক্ বাঁচাইয়া দান করিবে। যাহারা জ্ঞানার্জ্জনী ও কার্য্যকারিণী বৃত্তি বিহিত অনুশীলিত করিয়াছে, তাহাদের পক্ষে ইহা কঠিন নহে। কেন না, তাহারা বিচারক্ষম অথচ দয়াপর। অতএব মনুষ্যের সকল বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলন ব্যতীত কোন বৃত্তিই সম্পূর্ণ হয় না।

গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ে দান সম্বন্ধে ভগবদুক্তি আছে, তাহারও তাৎপর্য্য এইরূপ-

দাতব্যমিতি যদ্দনং দীয়তেহনুপকারিণে।

দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতং ||

যত্তু প্রত্যুপকারার্থং ফলমুদ্দিশ্য বা পুনঃ।

দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং তদ্দানং রাজসং স্মৃতং ||

অদেশকালে যদ্দানমপাত্রেভ্যশ্চ দীয়তে।

অসৎকৃতমবজ্ঞাতং তত্তামসমুদাহৃতং ||

অর্থাৎ “দেওয়া উচিত, এই বিবেচনায় যে দান, যাহার প্রত্যুপকার করিবার সম্ভাবনা নাই, তাহাকে দান, দেশ কাল পাত্র বিবেচনা করিয়া যে দান, তাহাই সাত্ত্বিক দান। প্রত্যুপকারপ্রত্যাশায় যে দান, ফলের উদ্দেশ্যে যে দান, এবং অপ্রসন্ন হইয়া যে দান করা যায়, তাহা রাজস দান। দেশ কাল পাত্র বিচারশূন্য যে দান, অনাদরে এবং অবজ্ঞাযুক্ত যে দান, তাহা তামস দান।”

শিষ্য। দানের দেশ কাল পাত্র কিরূপে বিচার করিতে হইবে, গীতায় তাহার কিছু উপদেশ আছে কি?