ধর্ম্মতত্ত্ব
পঞ্চবিংশতিতম অধ্যায়-পশুপ্রীতি
গুরু। প্রীতিতত্ত্ব সম্বন্ধীয় আর একটি কথা বাকি আছে। অন্য সকল ধর্ম্মের অপেক্ষা হিন্দুধর্ম্ম যে শ্রেষ্ঠ, তাহার সহস্র উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এই প্রীতিতত্ত্ব যাহা তোমাকে বুঝাইলাম, ভিতরেই তাহার কত উদাহরণ পাওয়া যাইতে পারে। হিন্দুদিগের জাগতিক প্রীতি যাহা তোমাকে বুঝাইয়াছি, তাহাতেই ইহার চমৎকার উদাহরণ পাইয়াছ। অন্য ধর্ম্মেও সর্ব্বলোকে প্রীতিযুক্ত হইতে বলে বটে, কিন্তু তাহার উপযুক্ত মূল কিছুই নির্দ্দেশ করিতে পারে না। হিন্দুধর্ম্মের এই জাগতিক প্রীতি জগত্তত্ত্বে দৃঢ় বদ্ধমূল। ঈশ্বরের সর্ব্বব্যাপকতায় ইহার ভিত্তি। হিন্দুদিগের দম্পতিপ্রীতি সমালোচনায় আর একটি এই শ্রেষ্ঠাতার প্রমাণ পাওয়া যায়; হিন্দুদিগের দম্পতিপ্রীতি অন্য জাতির আদর্শস্থল; হিন্দুধর্ম্মের বিবাহপ্রথা ইহার কারণ।* আমি এক্ষণে প্রীতিতত্ত্বঘটিত আর একটি প্রমাণ দিব।
ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন। এই জন্য সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টি করিতে হইবে। কিন্তু সর্ব্বভূত বলিলে কেবল মনুষ্য বুঝায় না। সমস্ত জীব সর্ব্বভূতান্তর্গত। অতএব পশুগণও মনুষ্যের প্রীতির পাত্র। মনুষ্যও যেরূপ, প্রীতির পাত্র, পশুগণও সেইরূপ প্রীতির পাত্র। এইরূপ অভেদজ্ঞান আর কোন ধর্ম্মে নাই, কেবল হিন্দুধর্ম্মে ও হিন্দুধর্ম্ম হইতে উৎপন্ন বৌদ্ধধর্ম্মে আছে।
শিষ্য। কথা বৌদ্ধধর্ম্ম হিন্দুধর্ম্ম হইতে পাইয়াছে, না হিন্দুধর্ম্ম বৌদ্ধধর্ম্ম হইতে পাইয়াছে?
গুরু। অর্থাৎ তোমার জিজ্ঞাস্য যে, ছেলে বাপের বিষয় পাইয়াছে, না বাপ ছেলের বিষয় পাইয়াছে?
শিষ্য। বাপ কখন ছেলের বিষয় পায়?
গুরু। যে প্রকৃতির গতিবিরুদ্ধ পক্ষ সমর্থন করে, প্রমাণের ভার তাহার উপর। বৌদ্ধ পক্ষে প্রমাণ কি?
শিষ্য।কিছুই না বোধ হয়।হিন্দু পক্ষে প্রমাণ কি ?
গুরু। ছেলে বাপের বিষয় পায়, এই কথাই যথেষ্ট। তা ছাড়া বাজসনেয় উপনিষৎ শ্রুতি উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ দিয়াছি যে, সর্ব্বভূতের যে সাম্য, ইহা প্রাচীন বেদোক্ত ধর্ম্ম।
শিষ্য। কিন্তু বেদে ত অশ্বমেধাদির বিধি আছে।
গুরু। বেদ যদি কোন এক ব্যক্তিবিশেষ-প্রণীত একখানি গ্রন্থ হইত, তাহা হইলে না হয় বেদের প্রতি অসঙ্গতি দোষ দেওয়া যাইত। Thomas Acquinas সঙ্গে হর্বর্ট স্পন্সরের সঙ্গতি খোঁজা যত দূর সঙ্গত, বেদের ভিন্ন ভিন্ন অংশের সঙ্গতির সন্ধানও তত দূর সঙ্গত। হিংসা হইতে অহিংসার ধর্ম্মের উন্নতি। যাক্। হিন্দুধর্ম্মবিহিত “পশুদিগের প্রতি অহিংসা পরম রমণীয় ধর্ম্ম। যত্নে ইহার অনুশীলন করিবে। অহিন্দুরা যত্নে ইহার অনুশীলন করিয়া থাকে। খাইবার জন্য বা চাষের জন্য বা চড়িবার জন্য যাহারা গো মেষ অশ্বাদির পালন করে, আমি কেবল তাহাদের কথা বলিতেছি না। কুকুরের মাংস খাওয়া যায় না, তথাপি কত যত্নে খৃষ্টানেরা কুকুর পালন করে! তাহাতে তাহাদের কত সুখ! আমাদের দেশে কত স্ত্রীলোক বিড়াল পুষিয়া অপত্যহীনতার দুঃখ নিবারণ করে। একটি পক্ষী পুষিয়া কে না সুখী হয়? আমি একদা একখানি ইংরাজি গ্রন্থে পড়িয়াছিলাম,-যে বাড়ীতে দেখিবে-পিঞ্জরে পক্ষী আছে, জানিবে-সেই বাড়ীতে একজন বিজ্ঞ মানুষ আছে। গ্রন্থখানির নাম মনে নাই, কিন্তু বিজ্ঞ মানুষের কথা বটে।
* বাবু চন্দ্রনাথ বসু প্রণীত হিন্দুবিবাহ বিষয়ক পুস্তিকা দেখ।