গুরু। পশুশসৃষ্টি রক্ষিত হইতে পারে, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্টি রক্ষা পাইতে পারে না। কারণ, পশুদিগের স্ত্রীদিগের আত্মরক্ষার ও আত্মপালনের শক্তি আছে। মনুষ্যস্ত্রীর তাহা নাই। অতএব মনুষ্যজাতিমধ্যে পুরুষ দ্বারা স্ত্রীজাতির পালন ও রক্ষণ না হইলে স্ত্রীজাতির বিলোপের সম্ভাবনা।

শিষ্য। মনুষ্যজাতির অসভ্যাবস্থায় কিরূপ?

গুরু। যেরূপ অসভ্যাবস্থায় মনুষ্য পশুতুল্য, অর্থাৎ বিবাহপ্রথা নাই, সেই অবস্থায় স্ত্রীলোক সকল আত্মরক্ষায় ও আত্মপালনে সক্ষম কি না, তাহা বিচারের প্রয়োজন নাই। কেন না, তাদৃশ অসভ্যাবস্থার সঙ্গে ধর্ম্মের কোন সম্বন্ধ নাই। মনুষ্য যত দিন সমাজভুক্ত না হয় তত দিন তাহাদের শারীরিক ধর্ম্ম ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম নাই বলিলেও হয়। ধর্ম্মাচরণ জন্য সমাজ আবশ্যক। সমাজ ভিন্ন জ্ঞানোন্নতি নাই; জ্ঞানোন্নতি ভিন্ন ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান সম্ভবে না। ধর্ম্মজ্ঞান ভিন্ন ঈশ্বরে ভক্তি সম্ভবে না; এবং যেখানে অন্য মনুষ্যের সঙ্গে সম্বন্ধ নাই, সেখানে মনুষ্যে প্রীতি প্রভৃতি ধর্ম্মও সম্ভব না। অর্থাৎ অসভ্যাবস্থায়ে শারীরিক ধর্ম্ম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম্ম সম্ভব নহে।

ধর্ম্মজন্য সমাজ আবশ্যক। সমাজগঠনের পক্ষে একটি প্রথম প্রয়োজন বিবাহপ্রথা। বিবাহপ্রথার স্থূল মর্ম্ম এই যে, স্ত্রীপুরুষ এক হইয়া সাংসারিক ব্যাপার ভাগে নির্ব্বাহ করিবে। যাহার যাহা যোগ্য, সে সেই ভাগের ভারপ্রাপ্ত। পুরুষের ভাগ-পালন ও রক্ষণ। স্ত্রী অন্যভারপ্রাপ্ত, পালন ও রক্ষণে সক্ষম হইলেও বিরত। বহুপুরুষপরম্পরায় এইরূপ বিরতি ও অনভ্যাসবশতঃ সামাজিক নারী আত্মপালনে ও রক্ষণে অক্ষম। এ অবস্থায় পুরুষ স্ত্রীপালন ও রক্ষণ না করিলে অবশ্য স্ত্রীজাতির বিলোপ ঘটিবে। অথচ যদি পুনশ্চ তাহাদিগের সে শক্তি পুনরভ্যাসে পুরুষপরম্পরা উপস্থিত হইতে পারে, এমন কথা বল, তবে বিবাহপ্রথার বিলোপ এবং সমাজ ও ধর্ম্ম বিনষ্ট হইলে তাহার সম্ভাবনা নাই, ইহাও বলিতে হইবে।

শিষ্য। তবে পাশ্চাত্ত্যেরা যে স্ত্রীপুরুষেরা সাম্য স্থাপন করিতে চাহেন, সেটা সামাজিক বিড়ম্বনা মাত্র?

গুরু। সাম্য কি সম্ভবে? পুরুষে কি প্রসব করিতে পারে, না শিশুকে স্তন্য পান করাইতে পারে? পক্ষান্তরে স্ত্রীলোকের পল্‌টন লইয়া লড়াই চলে কি?

শিষ্য। তবে শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনের কথা যে পূর্ব্বে বলিযাছিলেন, তাহা স্ত্রীলোকের পক্ষে খাটে না?

গুরু। কেন খাটিবে না? যাহার যে শক্তি আছে, সে তাহার অনুশীলন করিবে। স্ত্রীলোকের যুদ্ধ করিবার শক্তি থাকে, তাহা অনুশীলিত করুক; পুরুষের স্তন্য পান করাইবার শক্তি থাকে, অনুশীলিত করুক।

শিষ্য। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, পাশ্চাত্য স্ত্রীলোকেরা ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক ছোড়া প্রভৃতি পৌরুষ কর্ম্মে বিলক্ষণ পটুতা লাভ করিয়া থাকে।

গুরু। অভ্যাস ও অনুশীলনে যে প্রভেদের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। অনুশীলন, শক্তির অনুকূল; অভ্যাস শক্তির অনুকূল; অভ্যাস, শক্তির প্রতিকূল। অনুশীলনে শক্তির বিকাশ; অভ্যাসে বিকার। এ সকল অভ্যাসের ফল, অনুশীলনের নহে। অভ্যাস, প্রয়োজনমতে কর্ত্তব্য, অনুশীলন সর্ব্বত্র কর্ত্তব্য।

যাক। এ তত্ত্ব যেটুকু বলা আবশ্যক, তাহা বলা গেল। এখন অপত্যপ্রীতি ও দম্পতিপ্রীতি সম্বন্ধে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা পুনরুক্ত করিয়া সমাপ্ত করি।

প্রথম, বলিয়াছি যে, অপত্যপ্রীতি স্বতঃস্ফূর্ত্ত। দম্পতিপ্রীতি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে; কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত্ত ইন্দ্রিয়লালসা ইহার সঙ্গে সংযুক্ত হইলে, ইহাও স্বতঃস্ফূর্ত্তির ন্যায় বলবতী হয়। এই উভয় বৃত্তিই এই সকল কারণে অতি দুর্দ্দমনীয় বেগবিশিষ্ট। অপত্যপ্রীতির ন্যায় দুর্দ্দমনীয় বেগবিশিষ্ট বৃত্তি মনুষ্যের আর আছে কিনা সন্দেহ। নাই বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।