ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। উপায়-হিন্দুধর্ম্মের ও প্রীতিতত্ত্বের সেই মূল সূত্র-সর্ব্বভূতে সমদর্শন। অপত্যপ্রীতি সেই জাগতিক প্রীতিতে নিমজ্জিত করিয়া, অপত্যপালন ও রক্ষণ ঈশ্বরোদ্দিষ্ট; সুতরাং অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম জানিয়া, “জগদীশ্বরের কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতেছি, আমার ইহাতে ইষ্টানিষ্ট কিছু নাই,” ইহা মনে বুঝিয়া, সেই অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিবে। তাহা হইলে এই অপত্যপালন ও রক্ষণধর্ম্ম নিষ্কাম ধর্ম্মে পরিণত হইবে। তাহা হইলে তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্মেরও অতিশয় সুনির্ব্বাহ হইবে; অথচ তুমি নিজে এক দিকে শোকমোহাদি, আর এক দিকে পাপ ও দুর্ব্বাসনা হইতে নিষ্কৃতি পাইবে।
শিষ্য। আপনি কি অপত্যস্নেহ-বৃত্তির উচ্ছেদ করিয়া তাহার স্থানে জাগতিক প্রীতির সমাবেশ করিতে বলেন?
গুরু। আমি কোন বৃত্তিরই উচ্ছেদ করিতে বলি না, ইহা পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি। তবে, পাশব বৃত্তি সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। পাশব বৃত্তিসকল স্বতঃস্ফূর্ত্ত। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা দমনই অনুশীলন। অপত্যস্নেহ পরম রমণীয় ও পবিত্র বৃত্তি। পাশব বৃত্তিগুলির সঙ্গে ইহার এই ঐক্য আছে যে, ইহা যেমন মনুষ্যের আছে, তেমনি পশুদিগেরও আছে। তাদৃশ সকল বৃত্তিই স্বতঃস্ফূর্ত্ত, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। অপত্যস্নেহও সেই জন্য স্বতঃস্ফূর্ত্ত। বরং সমস্ত মানসিক বৃত্তির অপেক্ষা ইহার বল দুর্দ্দমনীয় বলা যাইতে পারে। এখন অপত্যপ্রীতি যতই রমণীয় ও পবিত্র হউক না কেন, উহার অনুচিত স্ফূর্ত্তি অসামঞ্জস্যের কারণ, যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত তাহার সংযম না করিলে অনুচিত স্ফূর্ত্তি ঘটিয়া উঠে। এই জন্য উহার সংযম আবশ্যক। উহার সংযম না করিলে, জাগতিক প্রীতি ও ঈশ্বরে ভক্তি, উহার স্রোতে ভাসিয়া যায়। আমি বলিয়াছি, ঈশ্বরে ভক্তি ও মনুষ্যে প্রীতি, ইহাই ধর্ম্মের সার, অনুশীলনের মুখ্য উদ্দেশ্য, সুখের মূলীভূত এবং মনুষ্যত্বের চরম। অতএব অপত্যপ্রীতির অনুচিত স্ফুরণে এইরূপ ধর্ম্মনাশ, সুখনাশ, এবং মনুষ্যত্বনাশ ঘটিতে পারে। লোকে ইহার অন্যায় বশীভূত হইয়া ঈশ্বর ভুলিয়া যায়; ধর্ম্মাধর্ম্ম ভুলিয়া, অপত্য ভিন্ন আর সকল মনুষ্যকে ভুলিয়া যায়। আপনার অপত্য ভিন্ন আর কাহারও অন্য কিছু করিতে চাহে না। ইহাই অন্যায় স্ফূর্ত্তি। পক্ষান্তরে, অবস্থাবিশেষে ইহার দমন না করিয়া ইহার উদ্দীপনই বিধেয় হয়। অন্যান্য পাশব বৃত্তি হিতে ইহার এক পার্থক্য এই যে, ইহা কামাদি নীচ বৃত্তির ন্যায় সর্ব্বদা এবং সর্ব্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে। এমন নরপিশাচ ও পিশাচীও দেখা যায় যে, তাহাদের এই পরম রমণীয়, পবিত্র এবং সুখকর স্বাভাবিক বৃত্তি অন্তর্হিত। অনেক সময়ে সামাজিক পাপবাহুল্যে এই সকল বৃত্তির বিলোপ ঘটে। ধনলোভে পিশাচ পিশাচীরা পুত্র কন্যা বিক্রয় করে; লোকলজ্জাভয়ে কুলকলঙ্কিনীরা তাহদের বিনাশ করে; কুলকলঙ্কভয়ে কুলাভিমানীরা কন্যাসন্তান বিনাশ করে; অনেক কামুকী কামাতুর হইয়া সন্তান পরিত্যাগ হইয়া যায়। অতএব এই বৃত্তির অভাব বা লোপও অতি ভয়ঙ্কর অধর্ম্মের কারণ। যেখানে ইহা উপযুক্তরূপে স্বতঃস্ফূর্ত্ত না হয়, সেখানে অনুশীলন দ্বারা ইহাকে স্ফুরিত করা আবশ্যক। উপযুক্তমত স্ফুরিত ও চরিতার্থ হইলে ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন আর কোন বৃত্তিই ঈদৃশ সুখদ হয় না। সুখকারিতায় অপত্যপ্রীতি ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন সকল বৃত্তির অপেক্ষায় শ্রেষ্ঠ।
অপত্যপ্রীতি সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, দম্পতিপ্রীতি সম্বন্ধেও তাহা বলা যায়। অর্থাৎ (১) স্ত্রীর প্রতিপালন ও রক্ষণের ভার তোমার উপর। স্ত্রী নিজে আত্মরক্ষণে ও প্রতিপালনে অক্ষম। অতএব তাহা তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। স্ত্রীর পালন ও রক্ষা ব্যতীত প্রজার বিলোপ সম্ভাবনা। এজন্য তৎপালন ও রক্ষণ জন্য স্বামীর প্রাণপাত করাও ধর্ম্মসঙ্গত।
(২) স্বামীর পালন ও রক্ষণ স্ত্রীর সাধ্য নহে, কিন্তু তাঁহার সেবা ও সুখসাধন তাঁহার সাধ্য। তাহাই তাঁহার ধর্ম্ম। অন্য ধর্ম্ম অসম্পূর্ণ, হিন্দুধর্ম্ম সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্পূর্ণ; হিন্দুধর্ম্মে স্ত্রীকে সহধর্ম্মিণী বলিয়াছে। যদি দম্পতিপ্রীতিকে পাশব বৃত্তিতে পরিণত না করা হয়, তবে ইহাই স্ত্রীর যোগ্য নাম; তিনি স্বামীর ধর্ম্মের সহায়। অতএব স্বামীর সেবা, সুখসাধন ও ধর্ম্মের সহায়তা, স্ত্রীর ধর্ম্ম।