ইহার অপেক্ষা উন্নত ধর্ম্ম আর কি হইতে পারে? বিদ্যালয়ে এ সকল না পড়াইয়া, পড়ায় কি না-মেকলে প্রণীত ক্লাইভ ও হেষ্টিংস সম্বন্ধীয় পাপপূর্ণ উপন্যাস। আর সেই উচ্চ শিক্ষার জন্য আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলী উন্মত্ত।

পরে, প্রহ্লাদের বাক্যে পুনশ্চ ক্রুদ্ধ হইয়া দৈত্যপতি তাহাকে প্রাসাদ হইতে নিক্ষিপ্ত করিয়া, শম্বরাসুরের মায়ার দ্বারা ও বায়ুর দ্বারা প্রহ্লাদের বিনাশের চেষ্টা করিলেন। প্রহ্লাদ সে সকলে বিনষ্ট না হইলে, নীতিশিক্ষার জন্য তাহাকে পুনশ্চ গুরুগৃহে পাঠাইলেন। সেখানে নীতিশিক্ষা সমাপ্ত হইলে আচার্য্য প্রহ্লাদকে সঙ্গে করিয়া দৈত্যেশ্বরের নিকট লইয়া আসিলেন। দৈত্যেশ্বর পুনশ্চ তাহার পরীক্ষার্থ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন,-

“হে প্রহ্লাদ! মিত্রের ও শত্রুর প্রতি ভূপতি কিরূপ ব্যবহার করিবেন? তিনি সময়ে কিরূপ আচরণ করিবেন? মন্ত্রী বা অমাত্যের সঙ্গে বাহ্যে এবং অভ্যন্তরে,-চর, চৌর, শঙ্কিতে এবং অশঙ্কিতে,-সন্ধি বিগ্রহে, দুর্গ ও আটবিক সাধনে বা কণ্টকশোষণে-কিরূপ করিবেন, তাহা বল।

প্রহ্লাদ পিতৃপদে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “গুরু সে সব কথা শিখাইয়াছেন বটে, আমিও শিখিয়াছি। কিন্তু সে সকল নীতি আমার মনোমত নহে। শত্রু মিত্রের সাধন-জন্য সাম দান ভেদ দণ্ড, এই সকল উপায় কথিত হইয়াছে, কিন্তু পিতঃ! রাগ করিবেন না, আমি ত সেরূপ শত্রু মিত্র দেখি না। যেখানে সাধ্য নাই,* সেখানে সাধনের কি প্রয়োজন! যখন জগন্ময় জগন্নাথ পরমাত্মা গোবিন্দ সর্ব্বভূতাত্মা, তখন আর শত্রু মিত্র কে? তোমাতে ভগবান্ আছেন, আমাতে আছেন, আর সকলেও আছেন, তখন এই ব্যক্তি মিত্র, আর এই শত্রু, এমন করিয়া পৃথক্ ভাবিব কি প্রকারে? অতএব দুষ্ট-চেষ্টা-বিধি-বহুল এই নীতিশাস্ত্রে কি প্রয়োজন?”

হিরণ্যকশিপু ক্রুদ্ধ হইয়া প্রহ্লাদের বক্ষঃস্থলে পদাঘাত করিলেন। এবং প্রহ্লাদকে নাগপাশে বদ্ধ করিয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করিতে অসুরগণকে আদেশ করিলেন। অসুরেরা প্রহ্লাদকে নাগপাশে বদ্ধ করিয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়া পর্ব্বত চাপা দিল। প্রহ্লাদ তখন জগদীশ্বরের স্তব করিতে লাগিলেন। স্তব করিতে লাগিলেন, কেন না, অন্তিম কালে ঈশ্বরচিন্তা বিধেয়; কিন্তু ঈশ্বরের কাছে আত্মরক্ষা প্রার্থনা করিলেন না; কেন না, প্রহ্লাদ নিষ্কাম। প্রহ্লাদ ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া, তাঁহার ধ্যান করিতে করিতে তাঁহাতে লীন হইলেন। প্রহ্লাদ যোগী।# তখন তাঁহার নাগপাশ খসিয়া গেল, সমুদ্রের জল সরিয়া গেল; পর্ব্বতসকল দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রহ্লাদ নাগপাশ গাত্রোত্থান করিলেন। তখন প্রহ্লাদ আবার বিষ্ণুর স্তব করিতে লাগিলেন,-আত্মরক্ষার জন্য নহে, নিষ্কাম হইয়া স্তব করিতে লাগিলেন। বিষ্ণু তখন তাঁহাকে দর্শন দিলেন। এবং ভক্তের প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে বর প্রার্থনা করিতে আদেশ করিলেন। প্রহ্লাদ “সন্তুষ্টঃ সততং,” সুতরাং তাঁহার জগতে প্রার্থনীয় কিছুই নাই। অতএব তিনি কেবল চাহিলেন যে, “যে সহস্র যোনিতে আমি পরিভ্রমণ করিব, সে সকল জন্মেই যখন তোমার প্রতি আমার অচলা ভক্তি থাকে।” ভক্ত ভক্তিই প্রার্থনা করে, ভক্তির জন্য প্রার্থনা করে, মুক্তির জন্য বা অন্য ইষ্টসাধনের জন্য নহে।

* অর্থাৎ যখন পৃথিবীতে কাহাকেও শত্রু মনে করা উচিত নহে।
# সন্তুষ্ট সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়:।