প্রহ্লাদ আবার বিষ্ণুভক্তির উপদ্রব করিতেছে জানিয়া হিরণ্যকশিপু তাহাকে বিষ পান করাইতে আজ্ঞা দিলেন। বিষেও প্রহ্লাদ মরিল না। তখন দৈত্যেশ্বর পুরোহিতগণকে ডাকাইয়া অভিচার-ক্রিয়ার দ্বারা প্রহ্লাদের সংহার করিতে আদেশ করিলেন। তাঁহারা প্রহ্লাদকে একটু বুঝাইলেন; বলিলেন-তোমার পিতা জগতের ঈশ্বর, তোমার অনন্তে কি হইবে? প্রহ্লাদ “স্থিরমতি”;* প্রহ্লাদ তাঁহাদিগকে হাসিয়া উড়াইয়া দিল। তখন দৈত্য পুরোহিতেরা ভয়ানক অভিচার-ক্রিয়ার সৃষ্টি করিলেন। অগ্নিময়ী মূর্ত্তিমতী অভিচার-ক্রিয়া প্রহ্লাদের হৃদয়ে শূলাঘাত করিল। প্রহ্লাদের হৃদয়ে শূল ভাঙ্গিয়া গেল। তখন সেই মূর্ত্তিমান্ অভিচার, নিরপরাধ প্রহ্লাদের প্রতি প্রযুক্ত হইয়াছিল বলিয়া অভিচারকারী পুরোহিতদিগকেই ধ্বংস করিতে গেল। তখন প্রহ্লাদ “হে কৃষ্ণ!‌ হে অনন্ত! ইহাদের রক্ষা কর” বলিয়া সেই দহ্যমান পুরোহিতদিগের রক্ষার জন্য ধাবমান হইলেন। ডাকিলেন, “হে সর্ব্বব্যাপিন্, হে জগৎস্বরূপ, হে জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা, হে জনার্দ্দন! এই ব্রাহ্মণগণকে এই দুঃসহ মন্ত্রাগ্নি হইতে রক্ষা কর! যেমন সকল ভূতে সর্ব্বব্যাপী, জগদ্‌গুরু, বিষ্ণু তুমি আছ, তেমনই এই ব্রাহ্মণেরা জীবিত হউক! বিষ্ণু সর্ব্বগত বলিয়া যেমন অগ্নিকে আমি শত্রুপক্ষ বলিয়া ভাবি নাই, এ ব্রাহ্মণেরাও তেমনি-ইহারাও জীবিত হৌক। যাহারা আমাকে মারিতে আসিয়াছিল, যাহারা বিষ দিয়াছিল, যাহারা আমাকে আগুনে পোড়াইয়াছিল, হাতীর দ্বারা আমাকে আহত করিয়াছিল, সাপের দ্বারা দংশিত করিয়াছিল, আমি তাহাদের মিত্রভাবে আমার সমান দেখিয়াছিলাম, শত্রু মনে করি নাই, আজ সেই সত্যের হেতু এই এই পুরোহিতেরা জীবিত হউক।” তখন ঈশ্বরকৃপায় পুরোহিতেরা জীবিত হইয়া, প্রহ্লাদকে আশীর্ব্বাদ করিয়া গৃহে গমন করিল।

এমন আর কখন শুনিব কি? তুমি ইহার অপেক্ষা উন্নত ভক্তিবাদ, ইহার অপেক্ষা উন্নত ধর্ম্ম অন্য কোন দেশের কোন শাস্ত্রে দেখাইতে পার?#

শিষ্য। আমি স্বীকার করি, দেশীয় গ্রন্থসকল ত্যাগ করিয়া কেবল ইংরাজী পড়ায় আমাদিগের বিশেষ অনিষ্ট হইতেছে।

গুরু। এখন ভগবদ্গীতায় যে ভক্ত ক্ষমাশীল এবং শত্রু মিত্রে তুল্যজ্ঞানী বলিয়া কথিত হইয়াছে, তাহা কি প্রকার তাহা বুঝিলে?!

পরে, হিরণ্যকশিপু পুত্রের প্রভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এই প্রভাব কোথা হইতে হইল?” প্রহ্লাদ বলিলেন, “অচ্যুত হরি যাহাদের হৃদয়ে অবস্থান করেন, তাহাদের এইরূপ প্রভাব হইয়া থাকে। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করে-কারণাভাববশতঃ তাহারও অনিষ্ট হয় না। যে কর্ম্মের দ্বারা, মনে বা বাক্যে পরপীড়ন করে, তাহার সেই বীজে প্রভৃত অশুভ ফলিয়া থাকে।

কেশব আমাতেও আছেন, সর্ব্বভূতেও আছেন, ইহা জানিয়া আমি কাহারও মনে মন্দ ইচ্ছা করি না, কাহারও মন্দ করি না, কাহাকেও মন্দ বলি না। আমি সকলের শুভ চিন্তা করি, আমার শারীরিক বা মানসিক, দৈব বা ভৌতিক অশুভ কেন ঘটিবে? হরি সর্ব্বময় জানিয়া সর্ব্বভূতে এইরূপ অব্যভিচারিণী ভক্তি করা পণ্ডিতের কর্ত্তব্য।”

* অনিকেত: স্থিরমতির্ভক্তিমান্ মে প্রিয়ো: নর:।
# মনস্বী শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার স্বপ্রণীত “Oriental Christ” নামক উৎকৃষ্ট গ্রন্থে লিখিয়াছেন, “A suppliant for mercy on behalf of those very men who put him to death, he said-‘Father! Forgive them, for they know not what they do.’ Can ideal forgiveness go any further?” Ideal যায় বৈ কি, এই প্রহ্লাদচরিত্র দেখুন না।
! সম: শত্রৌ চ মিত্র চ তথা মনোপমানয়ো:।