শিষ্য। কিন্তু প্রহ্লাদ ত এখানে রক্ষা কামনা করিলেন-

গুরু। না, তিনি রক্ষা কামনা করেন নাই। তিনি কেবল ইহাই মনে স্থির বুঝিলেন যে, যখন আমার আরাধ্য বিষ্ণু আমাতেও আছেন, এই অস্ত্রেও আছেন, তখন এ অস্ত্রে কখন আমার অনিষ্ট হইবে না। সেই দৃঢ়নিশ্চয়তাই আরও স্পষ্ট হইতেছে। কেবল ইহাই বুঝান আমার উদ্দেশ্য। প্রহ্লাদচরিত্র যে উপন্যাস, তদ্বিষয়ে সংশয় কি? সে উপন্যাসে নৈসর্গিক বা অনৈসর্গিক কথা আছে, তাহাতে কি আসিয়া যায়? উপন্যাসে এরূপ অনৈসর্গিক কথা থাকিলে ক্ষতি কি? অর্থাৎ যেখানে উপন্যাসকারের উদ্দেশ্য মানস ব্যাপারের বিবরণ, জড়ের গুণ ব্যাখ্যা নহে, তখন জড়ের অপ্রকৃত ব্যাখ্যা থাকিলে মানস ব্যাপারের ব্যাখ্যা অস্পষ্ট হয় না। বরং অনেক সময় অধিকতর স্পষ্ট হয়। এই জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ কবির মধ্যে অনেকেই অতিপ্রকৃতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন।

তার পর অস্ত্রে প্রহ্লাদ মরিল না দেখিয়া, হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলিলেন, “ওরে দুর্ব্বুদ্ধি এখনও শত্রুস্তুতি হইতে নিবৃত্ত হ! মূর্খ হইস্ না, আমি এখনও তোকে অভয় দিতেছি।”

অভয়ের কথা শুনিয়া প্রহ্লাদ বলিল, “যিনি সকল ভয়ের অপহারী, যাঁহার স্মরণে জন্ম জরা যম প্রভৃতি সকল ভয়ই দূর হয়, সেই অনন্ত ঈশ্বর হৃদয়ে থাকিতে আমার ভয় কিসের?”

সেই “ভয়োদ্বৈগের্মুক্তো” কথা মনে কর। তার পর হিরণ্যকশিপু, সর্পগণকে আদেশ করিলেন যে, উহাকে দংশন কর। কথাটা উপন্যাস, সুতরাং এরূপ বর্ণনায় ভরসা করি, তুমি বিরক্ত হইবে না। সাপের কামড়ে প্রহ্লাদ মরিল না,-সে কথাও তোমার বিশ্বাস করিয়া কাজ নাই। কিন্তু যে কথার জন্য পুরাণকার এই সর্পদংশন-বৃত্তান্ত লিখিয়াছেন, তৎপ্রতি মনোযোগ কর-

স ত্বাসক্তমতিঃ কৃষ্ণে দশ্যমানো মহোরগৈঃ।

ন বিবেদাত্মনো গাত্রং তৎস্মৃত্যাহ্লাদসংস্থিতঃ ||

প্রহ্লাদের মন কৃষ্ণে তখন এমন আসক্ত যে, মহাসর্প সকল দংশন করিতেছে, তথাপি কৃষ্ণস্মৃতির আহ্লাদে তিনি ব্যথা কিছুই জানিতে পারিলেন না। এই আহ্লাদের জন্য সুখ দুঃখ সমান জ্ঞান হয়। সেই ভগবদ্বাক্য আবার স্মরণ কর “সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী!” “ক্ষমী” কি, পরে বুঝিবে, এমন “সমদুঃখসুখ” বুঝিলে?

শিষ্য। বুঝিলাম এই যে, ভক্তের মনে বড় একটা ভারি সুখ রাত্রি দিন রহিয়াছে বলিয়া, অন্য সুখ দুঃখ, সুখ দুঃখ বলিয়াই বোধ হয় না।

গুরু। ঠিক তাই। সর্প কর্ত্তৃক প্রহ্লাদ বিনষ্ট হইল না, দেখিয়া হিরণ্যকশিপু মত্ত হস্তিগণকে আদেশ করিলেন যে, উহাকে দাঁতে ফাড়িয়া মারিয়া ফেল। হস্তীদিগের দাঁত ভাঙ্গিয়া গেল, প্রহ্লাদের কিছুই হইল না; বিশ্বাস করিও না-উপন্যাস মাত্র। কিন্তু তাহাতে প্রহ্লাদ পিতাকে কি বলিলেন শুন,-

দন্তা গজানাং কুলিশাগ্রনিষ্ঠুরাঃ

শীর্ণা যদেতে ন বলং মমৈতৎ।

মহাবিপৎপাপবিনাশনোহয়ং

জনার্দ্দনানুস্মরণানুভাবঃ ||

“কুলিশাগ্রকঠিন এই সকল গজদন্ত যে ভাঙ্গিয়া গেল, ইহা আমার বল নহে। যিনি মহাবিপৎ ও পাপের বিনাশন, তাঁহারই স্মরণে হইয়াছে।”