প্রহ্লাদ বলিল, “পিতঃ! যে বিষ্ণু এই অনন্ত জগতের শাস্তা, যিনি আমাদের হৃদয়ে স্থিত, সেই পরমাত্মা ভিন্ন আর কে শিখায়?”

হিরণ্যকশিপু বলিলেন, “জগতের ঈশ্বর আমি; বিষ্ণু কে রে দুর্ব্বুদ্ধি!”

প্রহ্লাদ বলিল, “যাঁহার পরংপদ শব্দে ব্যক্ত করা যায় না, যাঁহার পরংপদ যোগীরা ধ্যান করে, যাঁহা হইতে বিশ্ব, এবং যিনিই বিশ্ব, সেই বিষ্ণু পরমেশ্বর।”

হিরণ্যকশিপু অতিশয় ক্রদ্ধ হইয়া বলিল, “মরিবার ইচ্ছা করিয়াছিসযে,পুনঃ পুনঃ এই কথা বলিতেছিস্? পরমেশ্বর কাহাকে বলে জানিস্ না? আমি থাকিতে আবার তোর পরমেশ্বর কে? ”

নির্ভীক প্রহ্লাদ বলিল, “পিতঃ, তিনি কেবল আমারই পরমেশ্বর! সকল জীবেরও তিনিই পরমেশ্বর,- তোমারও তিনি পরমেশ্বর, ধাতা, বিধাতা পরমেশ্বর! রাগ করিও না, প্রসন্ন হও।”

হিরণ্যকশিপু বলিল, “বোধ হয়, কোন পাপাশয় এই দুর্ব্বুদ্ধি বালকের হৃদয়ে প্রবেশ করিয়াছে।”

প্রহ্লাদ বলিল, “কেবল আমার হৃদয়ে কেন? তিনি সকল লোকেতেই অধিষ্ঠান করিতেছেন। সেই সর্ব্বস্বামী বিষ্ণু, আমাকে, তোমাকে, সকলকে সকল কর্ম্মে নিযুক্ত করিতেছেন।”

এখন, সেই ভগবদ্বাক্য স্মরণ কর। “যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয় কেন, তাহা বুঝিলে? সেই “হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্ম্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ” স্মরণ কর। এখন, ভয় হইতে মুক্ত যে ভক্ত সে কি প্রকার তাহা বুঝিলে? “ময্যর্পিতমনোবুদ্ধিঃ” কি বুঝিলে?* ভক্তের সেই সকল লক্ষণ বুঝাইবার জন্য এই প্রহ্লাদচরিত্র কহিতেছি।

হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে মারিয়া ফেলিতে হুকুম দিলেন। শত শত দৈত্য তাঁহাকে কাটিতে আসিল, কিন্তু প্রহ্লাদ “দৃঢ়নিশ্চয়”, “ঈশ্বরার্পিতমনোবুদ্ধি”-যাহারা মারিতে আসিল, প্রহ্লাদ তাহাদিগকে বলিল, “বিষ্ণু তোমাদের অস্ত্রেও আছেন, আমাতেও আছেন, এই সত্যানুসারে আমি তোমাদের অস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হইব না।” ইহাই “দৃঢ়নিশ্চয়।”

শিষ্য। জানি যে, বিষ্ণুপুরাণের উপন্যাসে আছে যে, প্রহ্লাদ অস্ত্রের আঘাতে অক্ষত রহিলেন। কিন্তু উপন্যাসেই এমন কথা থাকিতে পারে,-যথার্থ এমন ঘটনা হয় না। যে যেমন ইচ্ছা ঈশ্বরভক্ত হউক, নৈসর্গিক নিয়ম তাহার কাছে নিষ্ফল হয় না-অস্ত্রে পরমভক্তেরও মাংস কাটে।

গুরু। অর্থাৎ তুমি Miracle মান না। কথাটা পুরাতন। আমি তোমাদের মত ঈশ্বরের শক্তিকে সীমাবদ্ধ করিতে সম্মত নহি। বিষ্ণুপুরাণে যেরূপে প্রহ্লাদের রক্ষা কথিত হইয়াছে, ঠিক সেই রূপ ঘটিতে দেখা যায় না বটে তার উপন্যাস বলিয়াই সেই বর্ণনা সম্ভবপর হইয়াছে, ইহাও স্বীকার করি। কিন্তু একটি নৈসর্গিক নিয়মের দ্বারা ঈশ্বরানুকম্পায় নিয়ামন্তের অদৃষ্টপূর্ব্ব প্রতিষেধ যে ঘটিতে পারে না, এমত কথা তুমি বলিতে পার না। অস্ত্রে পরম ভক্তেরও মাংস কাটে, কিন্তু ভক্ত ঈশ্বরানুকম্পায় আপনার বল বা বুদ্ধি এরূপে প্রযুক্ত করিতে পারে যে, অস্ত্র নিষ্ফল হয়। বিশেষ যে ভক্ত, সে “দক্ষ”; ইহা পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, তাহার সকল বৃত্তিগুলি সম্পূর্ণ অনুশীলিত, সুতরাং সে অতিশয় কার্য্যক্ষম; ইহার উপর ঈশ্বরানুগ্রহ পাইলে সে যে নৈসর্গিক নিয়মের সাহায্যেই অতিশয় বিপন্ন হইয়াও আত্মরক্ষা করিতে পারিবে, ইহা অসম্ভব কি?# যাহাই হউক, এ সকল কথায় আমাদিগের কোন প্রয়োজন এক্ষণে দেখা যাইতেছে না,-কেন না, আমি ভক্তি বুঝাইতেছি, ভক্ত কি প্রকারে ঈশ্বরানুগ্রহ প্রাপ্ত হন, বা হন কি না, তাহা বুঝাইতেছি না। এরূপ কোন ফলই ভক্তের কামনা করা উচিত নহে,-তাহা হইলে তাঁহার ভক্তি নিষ্কাম হইবে না।

* ময্যার্পিমনোবুদ্ধির্যা মদ্ভক্ত: স মে প্রিয়:।
# ঠিক এই কথাটি প্রতিপন্ন করিবার জন্য সিপাহী হস্ত হইতে দেবী চৌধুরাণীর উদ্ধার বর্ত্তমান লেখক কর্ত্তৃক প্রণীত হইয়াছে। সময়ে মেঘোদয় ঈশ্বরের অনুগ্রহ; অবশিষ্ট ভক্তের নিজের দক্ষতা। দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে পাঠক এই ভক্তিব্যখ্যা মিলাইয়া দেখিতে পারেন।