ধর্ম্মতত্ত্ব
শিষ্য। এক্ষণে প্রহ্লাদচরিত্র শুনিতে বাসনা করি।
গুরু। প্রহ্লাদচরিত্র সবিস্তারে বলিবার আমার ইচ্ছাও নাই, প্রয়োজন নাই। তবে একটা কথা এই প্রহ্লাদচরিত্র বুঝাইতে চাই। আমি বলিয়াছি যে, কেবল, হা ঈশ্বর! যো ঈশ্বর! করিয়া বেড়াইলে ভক্তি হইল না। যে আত্মজয়ী, সর্ব্বভূতকে আপনার মত দেখিয়া সর্ব্বজনের হিতে রত, শত্রু মিত্রে সমদর্শী, নিষ্কাম কর্ম্মী-
সে-ই ভক্ত। এই কথা ভগবদ্গীতার উক্ত হইয়াছে দেখিয়াছি। এই প্রহ্লাদ তাহার উদাহরণ। ভগবদ্গীতার যাহা উপদেশ, বিষ্ণুপুরাণে তাহা উপন্যাসচ্ছলে স্পষ্টীকৃত। গীতায় ভক্তের যে সকল লক্ষণ কথিত হইয়াছে, তাহা যদি তুমি বিস্মৃত হইয়া থাক, সেই জন্য তোমাকে উহা আর একবার শুনাইতেছি।
অদ্বেষ্টা সর্ব্বভূতানাং মৈত্র্যঃ করুণ এব চ।
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী ||
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যার্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ ||
যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকোন্নোদ্বিজতে চ যঃ।
হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্ম্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ ||
অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ।
সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ ||
সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জ্জিতঃ ||
তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ।
অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্ মে প্রিয়ো নরঃ || গীতা ১২।১৩-২০
প্রথমেই প্রহ্লাদকে “সর্ব্বত্র সমদৃগ্বশী” বলা হইয়াছে।
সমচেতা জগত্যস্মিন্ যঃ সর্ব্বেষ্বেব জন্তুষু।
যথাত্মনি তথান্যত্র পরং মৈত্রগুণান্বিতঃ ||
ধর্ম্মাত্মা সত্যশৌচাদিগুণানামাকরস্তথা।
উপমানমশেষণাং সাধূনাং যঃ যদাভবৎ ||
কিন্তু কথায় গুণবাদ করিলে কিছু হয় না, কার্য্যতঃ দেখাইতে হয়। প্রহ্লাদের প্রথম কার্য্যে দেখি, তিনি সত্যবাদী। সত্যে তাঁহার একটা দার্ঢ্য হয়, কোন প্রকার ভয়ে ভীত হইয়া তিনি সত্য পরিত্যাগ করেন না। গুরুগৃহ হইতে তিনি পিতৃসমীপে আনীত হইলে, হিরণ্যকশিপু তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি শিখিয়াছ? তাহার সার বল দেখি?”
প্রহ্লাদ বলিলেন, “যাহা শিখিয়াছি, তাহার সার এই যে, যাঁহার আদি নাই, অন্ত নাই, মধ্য নাই-যাঁহার বৃদ্ধি নাই, ক্ষয় নাই-যিনি অচ্যুত, মহাত্মা, সর্ব্বকারণের কারণ তাঁহাকে নমস্কার।”
শুনিয়া বড় ক্রুদ্ধ হইয়া হিরণ্যকশিপু আরক্ত লোচনে, কম্পিতাধরে প্রহ্লাদের গুরুকে ভর্ৎসনা করিলেন। গুরু বলিল, “আমার দোষ নাই, আমি এ সব শিখাই নাই।”
তখন হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কে শিখাইল রে?”