শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
কিন্তু শ্লোকটার ভাবার্থ বোধ করি, এখনও পরিষ্কার হয় নাই। ‘আত্মা অবিনাশী-কেহ তাহার বিনাশ করিতে পারে না-অতএব যুদ্ধ কর,’ এই কথার অর্থ কি? আত্মা অবিনাশী বলিয়া কাহাকে হত্যা করায় কি দোষ নাই? ভগবদ্বাক্যের সে তাৎপর্য্য নহে।ইহার তাৎপর্য্য উপরিধৃত শঙ্করভাষ্যে যাহা কথিত হইয়াছে, তাই। অর্জ্জুন যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তবে মোহে অভিভূত হইয়া, মানুষ মারিতে হইবে, এই দুঃখে তাহা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইতেছেন। ভগবান্ বুঝাইতেছেন যে, দুঃখ করিবার কারণ কিছুই নাই-কেন না, কেহই মরিবে না। শরীর নষ্ট হইবে বটে, কিন্তু শরীর ত অনিত্য, অর্জ্জুন যুদ্ধ না করিলেও এক দিন অবশ্য নষ্ট হইবে। কিন্তু শরীর নষ্ট হইলে মানুষ মরে না-যাহার শরীর, সে অমর-কেহই তাহাকে মারিতে পারে না। অতএব যুদ্ধের প্রতি অর্জ্জুন যে আপত্তি উপস্থিত করিতেছেন, সেটা ভ্রমরজনিত মাত্র। অতএব তিনি যুদ্ধ করিতে পারেন।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ১৯ ||
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ১৯ ||
যে ইঁহাকে হন্তা বলিয়া জানে, এবং যে ইঁহাকে হত বলিয়া জানে, ইহারা উভয়েই অনভিজ্ঞ। ইনি হত্যা করেন না-হতও হয়েন না।১৯।
প্রাচীন টীকাকারেরা এই শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা করেন; যথা-ভীষ্মাদির, মৃত্যু নিমিত্ত অর্জ্জুনের শোক, উক্ত বাক্যে নিবারিত হইল। এক্ষণে “আমি ইহাদের বধের কর্ত্তা।” এই নিমিত্ত যে দুঃখ, প্রথম অধ্যায়ে ৩৪।৩৫ ইত্যাদি শ্লোকে অর্জ্জুনের দ্বারা উক্ত হইয়াছে, তাহার উত্তরে ভগবান্ বুঝাইতেছেন যে, আত্মা যেমন কাহারও কর্ত্তৃক হত হয়েন না, তেমনি তিনি কাহাকেও হত্যা করেন না। কেন না, আত্মা অবিক্রিয়।
শঙ্কর ও শ্রীধর প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায়েরা যেরূপ অর্থ করিয়াছেন, আমি এক্ষণে সেইরূপ বলিতেছি। ইহার পরবর্ত্তী শ্লোকেরও সেইরূপ অর্থ করিব। অন্য অর্থ হয় কি না, তাহাও বলা যাইবে। টীকাকারেরা বলেন, আত্মা যে অবিক্রিয়, তাহার প্রমাণ পরবর্ত্তী শ্লোকে দেওয়া হইতেছে।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে || ২০ ||
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে || ২০ ||
ইনি জন্মেন না বা মরেন না, কখন হয়েন নাই, বর্ত্তমান নাই বা হইবেন না। ইনি অজ, নিত্য, শাশ্বত, পুরাণ; শরীর হত হইলে ইনি হত হয়েন না।২০।
টীকাকারেরা বলেন, আত্মা বা অবিক্রিয়, ইঁহার ষড়্ভাববিকারশূন্যত্বের দ্বারা দৃঢ়ীকৃত করা হইতেছে। ইনি জন্মশূন্য-এই কথার দ্বারা জন্ম প্রতিষিদ্ধ হইল; মরেন না-ইহাতে বিনাশ প্রতিষিদ্ধ হইল। ইনি কখন উৎপন্ন হয়েন নাই, এজন্য বর্ত্তমান নাই। যাহা জন্মে, তাহাকেই বর্ত্তমান বলা যায়; কিন্ত ইনি পূর্ব্ব হইতে স্বতঃ সদ্রূপে আছেন, অতএব উৎপন্ন হইয়া যে বিদ্যমানতা, তাহা ইঁহার নাই। এবং সেই জন্য ইনি আবার জন্মিবেন না। সেই জন্য ইনি অজ অর্থাৎ জন্মশূন্য, ইনি নিত্য অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপ, শাশ্বত অর্থাৎ অপক্ষয়শূন্য, পুরাণ অর্থাৎ বিপরিণামশূন্য।
এক্ষণে পাঠক, এই দুইটি শ্লোকের প্রতি মনোভিনিবেশ করিলেই দেখিতে পাইবেন যে, আত্মার এই অবিক্রিয়ত্ববাদ সম্বন্ধে কোন কথা স্পষ্টতঃ মূলে নাই। অস্পষ্টতঃ “নায়ঃ হন্তি” এই কথাটা আছে, কিন্তু ইহার অন্য অর্থ না হইতে পারে, এমনও নহে। যদি কেহ মরে না, তবে আত্মাও কাহাকে মারে না।
আত্মা যে অবিক্রিয়, ইহা প্রাচীন দর্শনশাস্ত্রের একটি মত। তত্ত্বটা কি, তাহা পাঠককে বুঝান যাইতে পারে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ উত্থাপিত করা আবশ্যক বোধ হইতেছে না। আবশ্যক বোধ হইতেছে না, তাহার কারণ, আমরা গীতার ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত, কিন্তু এই দুটি শ্লোক গীতার নহে। শ্লোক দুটি কঠোপনিষদের। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের যেটি ১৯শ শ্লোক, তাহা কঠোপনিষদেরও দ্বিতীয় বল্লীর ১৯শ শ্লোক; আর গীতার ঐ অধ্যায়ের যেটি ২০শ শ্লোক, তাহাও কঠোপনিষদের ঐ বল্লীর ২৮শ শ্লোক। গীতার শ্লোক ও কঠোপনিষদের শ্লোক পাশাপাশি লেখা যাইতেছে।