কথাটা উঠিতে পারে যে, ঈশ্বর যদি সাকার নহেন, তবে হিন্দুধর্ম্মের অবতারবাদের কি হইবে? এই গীতার বক্তা কৃষ্ণকে উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাউক। ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু কৃষ্ণ সাকার। ইঁহাকে তবে কি প্রকারে ঈশ্বরাবতার বলা যাইবে? এই প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর আমি কৃষ্ণচরিত্র নামক মৎপ্রণীত গ্রন্থে দিয়াছি, সুতরাং এখানে সে সকল কথা পুনর্ব্বার বলিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্, সুতরাং ইচ্ছানুসারে তিনি যে আকার ধারণ করিতে পারেন না, একথা বলিলে তাঁহার শক্তির সীমা নির্দ্দেশ করা হয়।

“যেন সর্ব্বমিদং ততম্” ইত্যাদি বাক্যে অনেকের এইরূপ ভ্রম জন্মিতে পারে যে, বিলাতী Pantheism এবং হিন্দুধর্ম্মের ঈশ্বরবাদ বুঝি একই। স্থানান্তরে এই ভ্রমের নিরাস করা যাইবে।

অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যসোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য অস্মাদ্‌যুদ্ধস্ব ভারত || ‍১৮ ||

নিত্য, অবিনাশী এবং অপ্রমেয় আত্মার এই দেহ নশ্বর বলিয়া কথিত হইয়াছে। অতএব হে ভারত! যুদ্ধ কর।১৮।

নিত্য, অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপে স্থিত (শ্রীধর)।

অপ্রমেয় অর্থাৎ অপরিচ্ছন্ন। প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা অপরিচ্ছেদ্য। প্রত্যক্ষাদির অতীত।

শ্রীধর এই শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা করেন-“নিত্য অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপ, অতএব অবিনাশী, ও অপ্রমেয় অর্থাৎ অপরিচ্ছিন্ন যে আত্মা, তাঁহার এই দেহ সুখদুঃখাদিধর্ম্মক, ইহা তত্ত্বদর্শীদিগের দ্বারা উক্ত; যখন আত্মার বিনাশ নাই, সুখদুঃখাদি সম্বন্ধ নাই, তখন মোহজনিত শোক পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর, অর্থাৎ স্বধর্ম্ম ত্যাগ করিও না।”

এই শ্লোকের ব্যাখ্যার পর শঙ্করাচার্য্য যাহা বলিয়াছেন, তাহার প্রতি বিশেষ মনোযোগ আবশ্যক। তিনি বলেন-“ইহাতে যুদ্ধের কর্ত্তব্যতা বিধান করা হইতেছে না। যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াও তিনি শোকমোহপ্রতিবদ্ধ হইয়া তূষ্ণীম্ভাবে আছেন, ভগবান্ তাঁহার কর্ত্তব্যপ্রতিবন্ধের অপনয়ন করিতেছেন মাত্র। অতএব ‘যুদ্ধ কর’ ইহা অনুবাদ মাত্র, বিধি নয়।”

অনেকের বিশ্বাস যে, এই গীতাগ্রন্থের স্থূল উদ্দেশ্য-যুদ্ধের ন্যায় নৃশংস ব্যাপারে মনুষ্যের প্রবৃত্তি দেওয়া। তাঁহারা যে গীতা বুঝিবার চেষ্টা করেন নাই, তাহা বলা বাহুল্য। গীতা বাজারের উপন্যাস-গ্রন্থ নহে যে, একবার পড়িবা মাত্র উহার সমস্ত তাৎপর্য্য বুঝা যাইবে। বিশেষরূপে উহার আলোচনা না করিলে বুঝা যায় না। গীতার এতদংশের উদ্দেশ্য-স্বধর্ম্মপালনে অপরিহার্য্যতা প্রতিপন্ন করা। স্বধর্ম্ম বলিলে শিক্ষিত সম্প্রদায় বুঝিতে কষ্ট পাইতে পারেন, ইহার ইংরাজি প্রতিশব্দDuty ধর্ম্মের অবশ্যসম্পাদ্যতা প্রতিপন্ন করা। সকল মনুষ্যের স্বধর্ম্ম একপ্রকার নহে- কাহারও স্বধর্ম্ম দন্ড-প্রণয়ন; কাহারও স্বধর্ম্ম ক্ষমা। সিপাহীর স্বধর্ম্ম শত্রুকে আঘাত করা, ডাক্তারের স্বধর্ম্ম সেই আঘাতের চিকিৎসা। মনুষ্যের যত প্রকার কর্ম্ম আছে, তত প্রকার স্বধর্ম্ম আছে। কিন্তু সকল প্রকার স্বধর্ম্মমধ্যে যুদ্ধই সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ব্যাপার। যুদ্ধ পরিহার করিতে পারিলে যুদ্ধ কাহারও কর্ত্তব্য নহে। কিন্তু এমন অবস্থা ঘটে যে, এই নৃশংস কার্য্য পরিহার্য্য ও অবশ্যসম্পাদ্য হইয়া উঠে। তৈমুরলঙ্গ বা নাদের দেশ দগ্ধ ও লুণ্ঠিত করিতে আসিতেছে, এমন অবস্থায় যে যুদ্ধ করিতে জানে, যুদ্ধ তাহারই অপরিহার্য্য ও অবশ্য সম্পাদ্য স্বধর্ম্ম। অতএব গীতাকার স্বধর্ম্ম পালন সম্বন্ধে ইংরাজি দর্শনশাস্ত্রে যাহাকে Crucial instance বলে, তাহাই অবলম্বন করিয়া স্বধর্ম্মের অবশ্যসম্পাদ্যতা এবং তদুপলক্ষে সমস্ত ধর্ম্মেরও নিগূঢ় রহস্য ব্যাখ্যাত করিতেছেন। উদাহরণস্বরূপ যে স্বধর্ম্ম সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ভয়াবহ ও যাহাতে সাধুজন মাত্রই স্বতঃ অপ্রবৃত্ত, তাহাই গ্রহণ করা হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে-যুদ্ধের মধ্যে যে যুদ্ধ সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ও ভয়াবহ, যাহাতে স্বভাবতঃ নৃশংস ব্যক্তিও সহজে প্রবৃত্ত হইতে চাহে না, তাহাই উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করিয়াছেন। Crucial instance বটে। গীতার উদ্দেশ্য ইহাই প্রতিপাদন করা যে, স্বধর্ম্ম এরূপ নৃশংস, ভয়াবহ এবং সাধুজনপ্রবৃত্তির আপাত-বিরোধী হইলেও তাহা অবশ্য পালনীয়।