ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোম্তের প্রথম চারি- Mathematics, Astronomy, Physics, Chemistry, গণিত, জ্যোতিষ, পদার্থতত্ত্ব এবং রসায়ন। এই জ্ঞানের জন্য আজিকার দিনে পাশ্চাত্ত্যদিগকে গুরু করিবে। তার পর আপনাকে জানিবে কোন্ শাস্ত্রে?
শিষ্য। বহির্ব্বিজ্ঞানে এবং অন্তর্ব্বিজ্ঞানে।
গুরু। অর্থাৎ কোম্তের শেষ দুই-Biology, Sociology, এ জ্ঞানও পাশ্চাত্ত্যের নিকট যাচ্ঞা করিবে।
শিষ্য। তার পর ঈশ্বর জানিব কিসে?
গুরু। হিন্দুশাস্ত্রে। উপনিষদে, দর্শনে, পুরাণে, ইতিহাসে, প্রধানতঃ গীতায়।
শিষ্য। তবে, জগতে যাহা কিছু জ্ঞেয় সকলই জানিতে হইবে। পৃথিবীতে যত প্রকার জ্ঞানের প্রচার হইয়াছে, সব জানিতে হইবে। তবে জ্ঞান এখানে সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে?
গুরু। যাহা তোমাকে শিখাইয়াছি, তাহা মনে করিলেই ঠিক বুঝিবে। জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের সম্যক্ স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি হওয়া চাই। সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানের চর্চ্চা ভিন্ন তাহা হইতে পারে না। জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি হইলে, সেই সঙ্গে অনুশীলন ধর্ম্মের ব্যবস্থানুসারে যদি ভক্তি বৃত্তিরও সম্যক্ স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি হইয়া থাকে, তবে জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলি যখন ভক্তির অধীন হইয়া ঈশ্বরমুখী হইবে, তখনই এই গীতোক্ত জ্ঞানে পৌঁছিবে। অনুশীলনধর্ম্মেই যেমন কর্ম্মযোগ, অনুশীলনধর্ম্মেই তেমন জ্ঞানযোগ।
শিষ্য। গণ্ডমূর্খের মত আপনার ব্যাখ্যাত অনুশীলনধর্ম্ম সকলই উল্টা বুঝিয়াছিলাম; এখন কিছু কিছু বুঝিতেছি।
গুরু। এক্ষণে সে কথা যাউক। এই জ্ঞানযোগ বুঝিবার চেষ্টা কর।
শিষ্য। আগে বলুন, কেবল জ্ঞানেই কি প্রকারে ধর্ম্মের পূর্ণতা হইতে পারে? তাহা হইলে পণ্ডিতই ধার্ম্মিক।
গুরু। এ কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। পাণ্ডিত্য জ্ঞান নহে। যে ঈশ্বর বুঝিয়াছে, যে ঈশ্বরের জগতে যে সম্বন্ধ, তাহা বুঝিয়াছে, সে কেবল পণ্ডিত নহে, সে জ্ঞানী। পণ্ডিত না হইলেও সে জ্ঞানী। শ্রীকৃষ্ণ এমত বলিতেছেন না যে, কেবল জ্ঞানেই তাঁহাকে কেহ পাইয়াছে। তিনি বলিতেছেন,
বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ।
বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ || ৪।১০
অর্থাৎ যাহারা চিত্তসংযত এবং ঈশ্বরপরায়ণ, তাহারাই জ্ঞানের দ্বারা পূত হইয়া তাঁহাকে পায়, আসল কথা, কৃষ্ণোক্ত ধর্ম্মের এমন মর্ম্ম নহে যে, জ্ঞানের দ্বারাই সাধন সম্পূর্ণ হয়। জ্ঞান ও কর্ম্ম উভয়ের সংযোগ চাই।* কেবল কর্ম্মে হইবে না, কেবল জ্ঞানেও নহে। কর্ম্মেই আবার জ্ঞানের সাধন। কর্ম্মের দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়। ভগবান্ বলিতেছেন,-
* বলা বাহুল্য যে, এই কথা জ্ঞানবাদী শঙ্করাচার্য্যের মতের বিরুদ্ধ। তাঁহার মতে জ্ঞান কর্ম্মে সমুচ্চয় নাই। শঙ্করাচার্য্যের মতের যাহা বিরোধী, শিক্ষিত সম্প্রদায় ভিন্ন আর কেহ আমার কথায় এখনকার দিনে গ্রহণ করিবেন না, তাহা আমি জানি। পক্ষান্তরে ইহাও কর্ত্তব্য যে, শ্রীধর স্বামী প্রভৃতি ভক্তিবাদিগণ শঙ্করাচার্য্যের অনুবর্ত্তী নন। এবং অনেক অনুগামী পণ্ডিত শঙ্করের মতের বিরোধী বলিয়াই তাঁহাকে স্বপক্ষসমর্থন জন্য ভাষ্যের মধ্যে বড় বড় প্রবন্ধ লিখিতে হইয়াছে।