গুরু। ঠিক সেই কথারই উত্তর দিতে যাইতেছিলাম। তুমি যদি উদরপূর্ত্তির আকাঙ্ক্ষা করিয়া ভাত খাইতে বসো, তবে তোমার কর্ম্ম নিষ্কাম হইল না। তুমি যদি দেশের দুঃখ নিজের দুঃখতুল্য বা তদধিক ভাবিয়া তাহার উদ্ধারের চেষ্টা করিলে, তাহা হইলেও কর্ম্ম নিষ্কাম হইল না।

শিষ্য। যদি সে আকাঙ্ক্ষা না থাকে, তবে কেনই এই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইব?

গুরু। কেবল ইহা তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়া। আহার এবং দেশোদ্ধার, উভয়ই তোমার অনুষ্ঠেয়। চৌর্য্য তোমার অনুষ্ঠেয় নহে।

শিষ্য। তবে কোন্ কর্ম্ম অনুষ্ঠেয়, আর কোন কর্ম্ম অনুষ্ঠেয় নহে, তাহা কি প্রকারে জানিব? তাহা না বলিলে ত নিষ্কাম ধর্ম্মের গোড়াই বোঝা গেল না?

গুরু। এ অপূর্ব্ব ধর্ম্ম-প্রণেতা কোন কথাই ছাড়িয়া যান নাই। কোন্ কর্ম্ম অনুষ্ঠেয়, তাহা বলিতেছেন,-

যজ্ঞার্থাং কর্ম্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ।

তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচার || ৩।৯

এখানে যজ্ঞ শব্দে ঈশ্বর। আমার কথায় তোমার ইহা বিশ্বাস না হয়, স্বয়ং শঙ্করাচার্য্যের কথার উপর নির্ভর কর। তিনি এই শ্লোকের ভাষ্যে লিখিয়াছেন;-

“যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতের্যজ্ঞ ঈশ্বরদস্তদর্থং।”

তাহা হইলে শ্লোকের অর্থ হইল এই যে, ঈশ্বরার্থ ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম তদ্ভিন্ন অন্য কর্ম্ম বন্ধন মাত্র (অনুষ্ঠেয় নহে); অতএব কেবল ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্মই করিবে। ইহার ফল দাঁড়ায় কি? দাঁড়ায় যে, সমস্ত বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরমুখী করিবে, নহিলে সকল কর্ম্ম ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম হইবে না। এই নিষ্কাম ধর্ম্মই নামান্তরে ভক্তি। এইরূপে কর্ম্ম ও ভক্তির সামঞ্জস্য। কর্ম্মের সহিত ভক্তির ঐক্য স্থানান্তরে আরও স্পষ্টীকৃত হইতেছে। যথা-

ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীর্নির্ম্মম ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ||

অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধিতে কর্ম্মসকল আমাতে অর্পণ করিয়া, নিষ্কাম হইয়া এবং মমতা ও বিকারশূন্য হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

শিষ্য। ঈশ্বরে কর্ম্ম অর্পণ কি প্রকারে হইতে পারে?

গুরু। “অধ্যাত্মচেতসা” এই বাক্যের সঙ্গে “সংন্যস্য” শব্দ বুঝিতে হইবে। ভগবান্ শঙ্করাচার্য্য “অধ্যাত্মচেতসা” শব্দের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন, “অহং কর্ত্তেশ্বরায় ভৃত্যবৎ করোমীত্যনয়া বৃদ্ধ্যা।” “কর্ত্তা যিনি ঈশ্বর, তাঁহারই জন্য, তাঁহার ভৃত্যস্বরূপ এই কাজ করিতেছি।” এইরূপ বিবেচনায় কাজ করিলে, কৃষ্ণে কর্ম্মার্পণ হইল।

এখন এই কর্ম্মযোগ বুঝিলে? প্রথমতঃ কর্ম্ম অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু কেবল অনুষ্ঠেয় কর্ম্মই কর্ম্ম। যে কর্ম্ম ঈশ্বরোদ্দিষ্ট, অর্থাৎ ঈশ্বরাভিপ্রেত, তাহাই অনুষ্ঠেয়। তাহাতে আসক্তিশূন্য এবং ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হইয়া তাহার অনুষ্ঠান করিতে হইবে। সিদ্ধি অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করিবে। কর্ম্ম ঈশ্বরে অর্পণ করিবে অর্থাৎ কর্ম্ম তাঁহার আমি তাঁহার ভৃত্য স্বরূপ কর্ম্ম করিতেছি, এইরূপ বুদ্ধিতে কর্ম্ম করিবে; তাহা হইলেই কর্ম্মযোগ সিদ্ধ হইল।

ইহা করিতে গেলে কার্য্যকারিণী ও শারীরিক বৃত্তি সকলকেই ঈশ্বরমুখী করিতে হইবে। অতএব কর্ম্মযোগই ভক্তিযোগ। ভক্তির সঙ্গে ইহার ঐক্য ও সামঞ্জস্য দেখিলে। এই অপূর্ব্ব তত্ত্ব, অপূর্ব্ব ধর্ম্ম কেবল গীতাতেই আছে। এইরূপ আশ্চর্য্য ধর্ম্মব্যাখ্যা আর কখন কোন দেশে হয় নাই। কিন্ত ইহার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তুমি এখন প্রাপ্ত হয় নাই। কর্ম্মযোগেই ধর্ম্ম সম্পূর্ণ হইল না, কর্ম্ম ধর্ম্মের প্রথম সোপান মাত্র। কাল তোমাকে জ্ঞানযোগের কথা কিছু বলিব।