ধর্ম্মতত্ত্ব
অর্থাৎ, তোমার কর্ম্মেই অধিকার, কদাচ কর্ম্মফলে যেন না হয় কর্ম্মের ফলার্থী হইও না; কর্ম্মত্যাগেও প্রবৃত্তি না হউক।
অর্থাৎ কর্ম্ম করিতে আপনাকে বাধ্য মনে করিবে, কিন্তু তাহার কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা করিবে না।
শিষ্য। ফলের আকাঙ্ক্ষা না থাকিলে কর্ম্ম করিব কেন? যদি পেট ভরিবার আকাঙ্ক্ষা না রাখি, তবে ভাত খাইব কেন?
গুরু। এইরূপ ভ্রম ঘটিবার সম্ভাবনা বলিয়া ভগবান্ পর-শ্লোকে ভাল করিয়া বুঝাইতেছেন-
“যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়!”
অর্থাৎ, হে ধনঞ্জয়! সঙ্গ ত্যাগ করিয়া যোগস্থ হইয়া কর্ম্ম কর।
শিষ্য। কিছুই বুঝিলাম না। প্রথম-সঙ্গ কি?
গুরু। আসক্তি। যে কর্ম্ম করিতেছ, তাহার প্রতি কোন প্রকার অনুরাগ না থাকে। ভাগ খাওয়ার কথা বলিতেছিলে। ভাত খাইতে হইবে সন্দেহ নাই; কেন না, “প্রকৃতিজ গুণে” তোমাকে খাওয়াইবে, কিন্তু আহারে যেন অনুরাগ না হয়। ভোজনে অনুরাগযুক্ত হইয়া ভোজন করিও না।
শিষ্য। আর “যোগস্থ” কি?
গুরু। পর-চরণে তাহা কথিত হইতেছে-
যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে ||
কর্ম্ম করিবে, কিন্তু কর্ম্মে সিদ্ধ হউক, অসিদ্ধ হউক, সমান জ্ঞান করিবে। তোমার যত দূর কর্ত্তব্য, তাহা তুমি করিবে। তাতে তোমার কর্ম্ম সিদ্ধ হয় আর নাই হয়, তুল্য জ্ঞান করিবে। এই যে সিদ্ধ্যসিদ্ধিকে সমান জ্ঞান করা, ইহাকেই ভগবান্ যোগ বলিতেছেন। এইরূপ যোগস্থ হইয়া, কর্ম্মে আসক্তিশূন্য হইয়া কর্ম্মের যে অনুষ্ঠান করা, তাহাই নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান।
শিষ্য। এখনও বুঝিলাম না। আমি সিঁধকাটি লইয়া আপনার বাড়ী চুরি করিতে যাইতেছি। কিন্তু আপনি সজাগ আছেন, এজন্য চুরি করিতে পারিলাম না। তার জন্য দুঃখিত হইলাম না। ভাবিলাম, “আচ্ছা, হলো হলো, না হলো না হলো।” আমি কি নিষ্কাম ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলাম?
গুরু। কথাটা ঠিক সোণার পাথরবাটির মত হইল। তুমি মুখে, হলো হলো, না হলো না হলো বল, আর নাই বল, তুমি যদি চুরি করিবার অভিপ্রায় কর, তাহা হইলে তুমি কখনই মনে এরূপ ভাবিতে পারিবে না। কেন না, চুরির ফলাকাঙ্ক্ষী না হইয়া, অর্থাৎ অপহৃত ধনের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া, তুমি কখন চুরি করিতে যাও নাই। যাহাকে “কর্ম্ম” বলা যাইতেছে, চুরি তাহার মধ্যে নহে। “কর্ম্ম” কি তাহা পরে বুঝাইতেছি। কিন্তু চুরি “কর্ম্ম” মধ্যে গণ্য হইলেও তুমি তাহা অনাসক্ত হইয়া কর নাই। এজন্য ঈদৃশ কর্ম্মানুষ্ঠানকে সৎ ও নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান বলা যাইতে পারে না।
শিষ্য। ইহাতে যে আপত্তি, তাহা পূর্ব্বেই করিয়াছি। মনে করুন, আমি বিড়ালের মত ভাত খাইতে বসি, বা উইলিয়ম সি সাইলেণ্টের মত দেশোদ্ধার করিতে বসি, দুইয়েতেই আমাকে ফলার্থী হইতে হইবে।অর্থাৎ উদরপূর্ত্তির আকাঙক্ষা করিয়া ভাতের পাতে বসিতে হইবে, এবং দেশের দুঃখনিবারণ আকাঙ্ক্ষা করিয়া দেশের উদ্ধারে প্রবৃত্ত হইতে হইবে।