ইহার উত্তর পূর্ব্বেই লিখিয়াছি। ইন্দ্রিয়ের অধীন যে সুখ, তাহা দুঃখের কারণ-তাহা দুঃখমধ্যে গণ্য। ইন্দ্রিয়াদির অনধীন যে সুখ, যথা-জ্ঞান, ভক্তি, প্রীতি, দয়াদিজনিত যে সুখ, তাহা গীতোক্ত ধর্ম্মানুসারে পরিত্যাজ্য নহে, বরং গীতোক্ত ধর্ম্মের সেই সুখই উদ্দেশ্য। আর ইন্দ্রিয়ের অধীন যে সুখ, তাহাও প্রকৃতপক্ষে পরিত্যাজ্য নহে। তৎপরিত্যাগও গীতোক্ত ধর্ম্মের উদ্দেশ্য নহে। তাহাতে অনাসক্তিই গীতোক্ত ধর্ম্মের উদ্দেশ্য, পরিত্যাগ উদ্দেশ্য নহে।

রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি || ২। ৬৪ ||

উক্ত চতুঃষষ্টিতম শ্লোকের ব্যখ্যাকালে আমরা এ বিষয়ে আরও কিছু বলিব।

আমরা দেখিতেছি যে দ্বাদশ শ্লোকে হিন্দুধর্ম্মের প্রথম তত্ত্ব সূচিত হইয়াছে-আত্মার অবিনাশিতা। ত্রয়োদশ শ্লোকে দ্বিতীয় তত্ত্ব-জন্মান্তরবাদ। চতুর্দ্দশ, পঞ্চদশ, এবং ষোড়শ শ্লোকে তৃতীয় তত্ত্ব সূচিত হইতেছে-সুখদুঃখের অনাত্মধর্ম্মিতা ও অনিত্যত্ব। সাংখ্যদর্শনের ব্যাখ্যার উপলক্ষে আত্মার সঙ্গে সুখদুঃখের সম্বন্ধ পূর্ব্বে যেরূপ বুঝাইয়াছিলাম, তাহা বুঝাইতেছি।

“শরীরাদি ব্যতিরিক্ত পুরুষ। কিন্তু দুঃখ ত শারীরদিক; শারীরাদিতে যে দুঃখের কারণ নাই,-এমন দুঃখ নাই। যাহাকে মানসিক দুঃখ বলি-বাহ্য পদার্থই তাহার মূল। আমার বাক্যে তুমি অপমানিত হইলে, আমার বাক্য প্রাকৃতিক পদার্থ, তাহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা তুমি গ্রহণ করিলে, তাহাতে তোমার দুঃখ। অতএব প্রকৃতি ভিন্ন দুঃখ নাই, কিন্তু প্রকৃতিঘটিত দুঃখ পুরুষে বর্ত্তে কেন? “অঙ্গোহয়ম্পুরুষঃ। পুরুষ একা, কাহারও সংসর্গবিশিষ্ট নহে। (১ম অধ্যায়ে ২৫শ সূত্র।) অবস্থাদি সকল শরীরের, আত্মার নহে। (ঐ, ১৪ সূত্র)। “ন বাহ্যান্তরয়োরুপরজ্যোপরঞ্জকভাবোহপি দেশব্যবধানাৎ স্রুঘ্নাস্থপাটলিপুত্রস্থয়োরিব।” বাহ্য এবং আন্তরিকের মধ্যে উপরজ্য এবং উপরঞ্জক ভাব নাই; কেন না, তাহা পরস্পর সংলগ্ন নহে, দেশব্যবধানবিশিষ্ট, যেমন এক জন পাটলিপুত্র নগরে থাকে আর এক জন স্রুঘ্ন নগরে থাকে, ইহাদিগের পরস্পরের ব্যবধান তদ্রূপ।

তবে পুরুষের দুঃখ কেন? প্রকৃতির সংযোগই দুঃখের কারণ। বাহ্যে আন্তরিকে দেশব্যবধান আছে বটে, কিন্তু কোন প্রকার সংযোগই নাই, এমত নহে। এমন স্ফাটিক পাত্রের নিকট জবাকুসুম রাখিলে পাত্র পুষ্পের বর্ণবিশিষ্ট হয় বলিয়া, পুষ্প এবং পাত্রে এক প্রকার সংযোগ আছে বলা যায়, এ সেইরূপ সংযোগ। পুষ্প এবং পাত্র মধ্যে দেশব্যবধান থাকিলেও পাত্রের বর্ণ বিকৃত হইতে পারে; ইহাও সেইরূপ। এ সংযোগ নিত্য নহে, দেখা যাইতেছে; সুতরাং তাহার উচ্ছেদ হইতে পারে। সেই সংযোগ উচ্ছেদ করিলেই দুঃখের কারণ অপনীত হইল। অতএব সংযোগের উচ্ছত্তিই দুঃখনিবারণের উপায়, সুতরাং তাহাই পুরুষার্থ। “যদ্বা তদ্বা তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থস্তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থঃ (৬, ৭)।47

অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যস্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুমর্হতি || ১৭ ||

যাহার দ্বারা এই সকলই ব্যাপ্ত, তাহাকে অবিনাশী জানিবে। এই অব্যয়ের কেহই বিনাশ করিতে পারে না।১৭।

“যাহার দ্বারা” অর্থাৎ পরমাত্মার দ্বারা। এই “সকলই” অর্থাৎ জগৎ। এই সমস্ত জগৎ পরমাত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত-শঙ্কর বলেন, যেমন ঘটাদি আকাশের দ্বারা ব্যাপ্ত, সেইরূপ ব্যাপ্ত।

47 প্রবন্ধ-পুস্তক হইতে উদ্ধৃত।