যদি বল, ঘট বিনষ্ট হইলে যখন ঘটবুদ্ধির ব্যভিচার হয়, তখন সেই সঙ্গে সঙ্গে সৎবুদ্ধিরও ব্যভিচার হউক (অর্থাৎ আপত্তিকারীর মতে ঘটবুদ্ধি ও সৎবুদ্ধি অভিন্ন, সুতরাং ঘটবুদ্ধির ব্যভিচার হইলে সৎবুদ্ধিরও ব্যভিচার হউক)। এই আপত্তি খাটিতে পারে না; কারণ তৎকালে সেই সৎবুদ্ধি ঘটাদিতে বর্ত্তমান থাকে, (সুতরাং উহার ব্যভিচার হয় না।) সে সৎবুদ্ধি বিশেষণভাবে অবস্থিত, সুতরাং (বিশেষ্যনাশে) বিনষ্ট হয় না।

যদি বল, সৎবুদ্ধির স্থলে যেরূপ যুক্তি অনুসারে একটি ঘট বিনষ্ট হইলেও অন্য ঘটে ত ঘটবুদ্ধি থাকে, “সুতরাং ঘটবুদ্ধি সৎ হউক,” এ আপত্তি ইহাতে খাটিতে পারে না; যেহেতু সে ঘটবুদ্ধি পটাদিতে থাকে না।

যদি বল, সৎবুদ্ধিও ঘট নষ্ট হইলে দৃষ্ট হয় না। এ কথা গুরুতর নহে। সৎবুদ্ধি বিশেষণভাবে অবস্থিত, বিশেষ্যের অভাব হইলে বিশেষণ থাকিতে পারে না। থাকিলে তাহার বিষয় কি হইবে? বিষয়ের অভাব হইলে সৎবুদ্ধি থাকে না। যদি বল, ঘটাদি বিশেষ্যের অভাব হইলেও বিশেষণ বিশেষ্যের ভাবে এক বিভক্তিতে উল্লেখ করা যায় বলিয়া ঘট সৎ হইবে, তাহার উত্তর এই যে, মরীচিকা প্রভৃতি স্থলেও সৎবুদ্ধি এবং উদক, উভয়ের অভাব হইলেও এক বিভক্তিতে ‘সৎ ইদং উদকং’ এরূপ ব্যবহার হয় (ইহার দ্বারা এক বিভক্তিতে উল্লেখ হওয়া সৎ অথবা অসৎ, এ উভয়ের কোন পক্ষেই প্রমাণ নহে)।

অতএব দেহাদি দ্বন্দ্ব কারণ হইতে উৎপন্ন ও অসৎ, উহার অস্তিত্ব নাই; এবং সৎ যে আত্মা, তাঁহারও কোথাও অভাব নাই, যেহেতু তাঁহার কোথাও ব্যভিচার হয় না। ইহাই সৎ এবং অসৎরূপ আত্মা এবং অনাত্মার স্বরূপনির্ণয়। যে সৎ, সে সৎই; যে অসৎ, সে অসৎই।46

শঙ্করাচার্য্য যেমন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত, এই দার্শনিক বিচারও তাহার উপযুক্ত। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার সঙ্গে ইহা বড় মিশিবে না। সুখ দুঃখকে সৎই বল, আর অসৎই বল, সুখ দুঃখ আছে। থাকিবে না সত্য, কিন্তু নাই, এ কথা বলিবার বিষয় নাই। কিন্তু থাকিবে না, এইটাই বড় কাজের কথা। তবে সহ্য করিতে পারিলেই দুঃখ নষ্ট হইবে।

“_____The darkest day,
Wait till to-morrow,
Will have passed away.”

এখন ১৪।১৫।১৬, এই তিন শ্লোকে যাহা উক্ত হইল, তাহা ভাল করিয়া না বুঝিলে, কয়েকটি আপত্তি উপস্থাপিত হইতে পারে। প্রথম আপত্তি দুঃখ সহ্য করিতে হইবে-নিবারণ করিতে হইবে না? অর্জ্জুনের দুঃখ, জ্ঞাতি-বন্ধু-বধ; যুদ্ধ না করিলেই সে দুঃখ নিবারণ হইল; দুঃখনিবারণের সহজ উপায় আছে। এ স্থলে তাঁহাকে দুঃখনিবারণ করিতে উপদেশ না দিয়া, ভগবান্ দুঃখ সহ্য করিতে উপদেশ দিতেছেন, ইহা কিরূপ উপদেশ? রোগীর রোগের উপশমের জন্য ঔষধ ব্যবহার করিতে পরামর্শ না দিয়া, তাহাকে রোগের দুঃখ সহ্য করিতে উপদেশ দেওয়ার সঙ্গে কি এ উপদেশ তুল্য নহে?

না তাহা নহে। দুঃখ নিবারণের কোন নিষেধ নাই। তবে যেখানে দুঃখ নিবারণ করিতে গেলে অধর্ম্ম হয়, সেখানে দুঃখ নিবারণ না করিয়া সহ্য করিব। যে যুদ্ধে অর্জ্জুন প্রবৃত্ত, তাহা ধর্ম্মযুদ্ধ। ধর্ম্মযুদ্ধের অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের আর ধর্ম্ম নাই। ধর্ম্ম পরিত্যাগে অধর্ম্ম। অতএব এ স্থলে দুঃখ সহ্য না করিয়া নিবারণ করিলে অধর্ম্ম আছে। এজন্য এখানে সহ্য করিতে হইবে, নিবারণ করা হইবে না।

দ্বিতীয় আপত্তি এই, দুঃখই সহ্য করিবে-সুখ সহ্য করা কিরূপ? সুখ দুঃখ সমান জ্ঞান করিব? তবে ভগবানের কি এই আজ্ঞা যে, পৃথিবীর কোন সুখে সুখ হইবে না? তবে আর asceticism কাহাকে বলে? সুখশূন্য ধর্ম্ম লইয়া কি হইবে?

46 শাঙ্কর ভাষ্যের এই অনুবাদ আমরা কোন বন্ধুর নিকট উপহার প্রাপ্ত হইয়াছি।