ধর্ম্মতত্ত্ব
পক্ষান্তরে, যে বৃত্তিগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহার অনুশীলনে আমাদের সমস্ত অবসর ও জীবিকানির্ব্বাহবিশিষ্ট শক্তির নিয়োগ করিলে, স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির আবশ্যকীয় স্ফূর্ত্তির কোন বিঘ্ন হয় না। কেন না, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত। কিন্তু উপাদানবিরোধহেতু তাহাদের দমন হইতে পারে বটে। কিন্তু ইহা দেখা গিয়াছে যে, এ সকলের দমনই যথার্থ অনুশীলন।
শিষ্য। কিন্তু যোগীরা অন্য বৃত্তির সম্প্রসারণ দ্বারা-কিম্বা উপায়ান্তরের দ্বারা, পাশব বৃত্তিগুলির ধ্বংস করিয়া থাকেন, এ কথা কি সত্য নয়?
গুরু। চেষ্টা করিলে যে কামাদির উচ্ছেদ করা যায় না, এমত নহে। সে ব্যবস্থা অনুশীলন ধর্ম্মের নহে, সন্ন্যাসকে আমি ধর্ম্ম বলি না-অন্ততঃ সম্পূর্ণ ধর্ম্ম বলি না। অনুশীলন প্রবৃত্তিমার্গ-সন্ন্যাস নিবৃত্তিমার্গ। সন্ন্যাস অসম্পূর্ণ ধর্ম্ম। ভগবান্ স্বয়ং কর্ম্মেরই শ্রেষ্ঠতা কীর্ত্তন করিয়াছেন; অনুশীলন কর্ম্মাত্মক।
শিষ্য। যাক্। তবে আপনার সামঞ্জস্য তত্ত্বের স্থূল নিয়ম একটা এই বুঝিলাম যে, যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা বাড়িতে দিব না, যে বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহা বাড়িতে দিতে পারি। কিন্তু ইহাতে একটা গোলযোগ ঘটে। প্রতিভা (Genius) কি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে? প্রতিভা একটি কোন বিশেষ বৃত্তি নহে, তাহা আমি জানি। কিন্তু কোন বিশেষ মানসিক বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্তিমতী বলিয়া তাহাকে কি বাড়িতে দিব না? তাহার অপেক্ষা আত্মহত্যা ভাল।
গুরু। ইহা যথার্থ।
শিষ্য। ইহা যদি যথার্থ হয়, এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি, আর এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি না, ইহা কোন্ লক্ষণ দেখিয়া নির্ব্বাচন করিব? কোন্ কষ্টিপাথরে ঘষিয়া ঠিক করিব যে, এইটি সোনা, এইটি পিতল।
গুরু। আমি বলিয়াছি যে, সুখের উপায় ধর্ম্ম, আর মনুষ্যত্বেই সুখ। অতএব সুখই সেই কষ্টিপাথর।
শিষ্য। বড় ভয়ানক কথা। আমি যদি বলি, ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিই সুখ?
গুরু। তাহা বলিতে পার না। কেন না, সুখ কি, তাহা বুঝাইয়াছি। আমাদের সমুদায় বৃত্তিগুলির স্ফূর্ত্তি, সামঞ্জস্য এবং উপযুক্ত পরিতৃপ্তিই সুখ।
শিষ্য। সে কথাটা এখনও আমার ভাল করিয়া বুঝা হয় নাই। সকল বৃত্তির স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তির সমবায় সুখ? না প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তিই সুখ।
গুরু। সমবায়ই সুখ। ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তির স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তি সুখের অংশ মাত্র।
শিষ্য। তবে কষ্টিপাথর কোন্টা? সমবায় না অংশ?
গুরু। সমবায়ই কষ্টিপাথর?
শিষ্য। এ ত বুঝিতে পারিতেছি না। মনে করুন, আমি ছবি আঁকিতে পারি। কতকগুলি বৃত্তিবিশেষের পরিমার্জ্জনে এ শক্তি জন্মে। কথাটা এই যে, সেই বৃত্তিগুলির সমধিক সম্প্রসারণ আমার কর্ত্তব্য কি না, আপনাকে এ প্রশ্ন করিলে আপনি বলিবেন, “সকল বৃত্তির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি ও চরিতার্থতার সমবায় যে সুখ, তাহার কোন বিঘ্ন হইবে কি না, এ কথা বুঝিয়া তবে চিত্রবিদ্যার অনুশীলন কর।” অর্থাৎ আমার তুলি ধরিবার আগে আমাকে গণনা করিয়া দেখিতে হইবে যে, ইহাতে আমার মাংসপেশীয় বল, শিরা ধমনীর স্বাস্থ্য, চক্ষের দৃষ্টি, শ্রবণের শ্রুতি-আমার ঈশ্বরে ভক্তি, মনুষ্যে প্রীতি, দীনে দয়া, সত্যে অনুরাগ-আমার অপত্যে স্নেহ, শত্রুতে ক্রোধ,-কোন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি, দার্শনিক ধৃতি,-আমার কাব্যের কল্পনা, সাহিত্যের সমালোচনা-কোন দিকে কিছুর বিঘ্ন হয় কি না। ইহাও কি সাধ্য?