ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। কঠিন বটে নিশ্চিত জানিও। ধর্ম্মাচরণ ছেলেখেলা নহে। ধর্ম্মাচরণ অতি দুরূহ ব্যাপার। প্রকৃত ধার্ম্মিক যে পৃথিবীতে এত বিরল, তাহার কারণই তাই। ধর্ম্ম সুখের উপায় বটে, কিন্তু বড় আয়াসলভ্য। সাধনা অতি দুরূহ। দুরূহ, কিন্তু অসাধ্য নহে।
শিষ্য। কিন্তু ধর্ম্ম ত সর্ব্বসাধারণের উপযোগী হওয়া উচিত।
গুরু। ধর্ম্ম, যদি তোমার আমার গড়িবার সামগ্রী হইত, ত না হয়, তুমি যাহাকে সাধারণের উপযোগী বলিতেছ, সেইরূপ করিয়া গড়িতাম। ফরমায়েস মত জিনিস গড়িয়া দিতাম। কিন্তু ধর্ম্ম তোমার আমার গড়িবার নহে। ধর্ম্ম ঐশিক নিয়মাধীন। যিনি ধর্ম্মের প্রণেতা, তিনি ইহাকে যেরূপ করিয়াছেন, সেইরূপ আমাকে বুঝাইতে হইবে। তবে ধর্ম্মকে সাধারণের অনুপযোগীও বলা উচিত নহে। চেষ্টা করিলে, অর্থাৎ অনুশীলনের দ্বারা সকলেই ধার্ম্মিক হইতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, এক সময়ে সকল মনুষ্যই ধার্ম্মিক হইবে। যত দিন তাহা না হয়, তত দিন তাহারা আদর্শের অনুসরণ করুক। আদর্শ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। তাহা হইলেই তোমার এ আপত্তি খণ্ডিত হইবে।
শিষ্য। আমি যদি বলি যে, আপনার ওরূপ একটা পারিভাষিক এবঞ্চ দুষ্প্রাপ্য সুখ মানি না, আমার ইন্দ্রিয়াদির পরিতৃপ্তিই সুখ?
গুরু। তাহা হইলে আমি বলিব, সুখের উপায় ধর্ম্ম নহে, সুখের উপায় অধর্ম্ম।
শিষ্য। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কি সুখ নহে? ইহাও বৃত্তির স্ফূরণ ও চরিতার্থতা বটে। আমি ইন্দ্রিয়গণকে খর্ব্ব করিয়া, কেন দয়া দাক্ষিণ্যাদির সমধিক অনুশীলন করিব, আপনি তাহার উপযুক্ত কোন কারণ দেখান নাই। আপনি ইহা বুঝাইয়াছেন বটে যে, ইন্দ্রয়াদির অধিক অনুশীলনে দয়া দাক্ষিণ্যাদির ধ্বংস সম্ভাবনা-কিন্তু তদুত্তরে আমি যদি বলি যে, ধ্বংস হউক, আমি ইন্দ্রিয়সুখে বঞ্চিত হই কেন?
গুরু। তাহা হইলে আমি বলিব, তুমি কিষ্কিন্ধ্যা হইতে পথ ভুলিয়া আসিয়াছ। যাহা হউক, তোমার কথার আমি উত্তর দিব। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি সুখ? ভাল, তাই হউক। আমি তোমাকে অবাধে ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত করিতে অনুমতি দিতেছি। আমি খত লিখিয়া দিতেছি যে, এই ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতে কখন কেহ কোন বাধা দিবে না, কেহ নিন্দা করিবে না,-যদি কেহ করে, আমি গুণাগারি দিব। কিন্তু তোমাকেও একখানি খত লিখিয়া দিতে হইবে। তুমি লিখিয়া দিবে যে, “আর ইহাতে সুখ নাই” বলিয়া তুমি ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি ছাড়িয়া দিবে না। শ্রান্তি, ক্লান্তি, রোগ, মনস্তাপ, আয়ুক্ষয়, পশুত্বে অধঃপতন প্রভৃতি কোনরূপ ওজর আপত্তি করিয়া ইহা কখন ছাড়িতে পারিবে না। কেমন, রাজি আছ?
শিষ্য। দোহাই মহাশয়ের! আমি নই। কিন্তু এমন লোক কি সর্ব্বদা দেখা যায় না, যাহারা যাবজ্জীবন ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিই সার করে? অনেক লোকই ত এইরূপ?
গুরু। আমারা মনে করি বটে, এমন লোক অনেক। কিন্তু ভিতরের খবর রাখি না। ভিতরের খবর এই-যাহাদিগকে যাবজ্জীবন ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেখি, তাহাদিগের ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি চেষ্টা বড় প্রবল বটে, কিন্তু তেমন পরিতৃপ্তি ঘটে নাই। যেরূপ তৃপ্তি ঘটিলে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দুঃখটা বুঝা যায়, সে তৃপ্তি ঘটে নাই। তৃপ্তি ঘটে নাই বলিয়াই চেষ্টা এত প্রবল। অনুশীলনের দোষে, হৃদয়ে আগুন জ্বলিয়াছে,-দাহ নিবারণের জন্য তারা জল খুঁজিয়া বেড়ায়; জানে না যে, অগ্নিদগ্ধের ঔষধ জল নয়।