ধর্ম্মতত্ত্ব
সপ্তম অধ্যায়-সামঞ্জস্য ও সুখ
গুরু। এক্ষণে নিকৃষ্ট কার্য্যকারিণী বৃত্তির কথা ছাড়িয়া দিয়া, যাহাকে উৎকৃষ্ট বৃত্তি বল, সে সকলের কথা বলি শুন।
শিষ্য। আপনি বলিয়াছেন, কতকগুলি কার্য্যকারিণী বৃত্তি, যথা ভক্ত্যাদি অধিক সম্প্রসারণে সক্ষম, এবং তাহাদিগের অধিক সম্প্রসারণেই সকল বৃত্তির সামঞ্জস্য। আর কতকগুলি বৃত্তি আছে, যথা কামাদি, সেগুলিও অধিক সম্প্রসারণে সক্ষম, সেগুলির অধিক সম্প্রসারণে সামঞ্জস্যের ধ্বংস। কতকগুলির আধিক্যে সামঞ্জস্য, কতকগুলির সম্প্রসারণের আধিক্যে অসামঞ্জস্য, এমন ঘটে কেন, তাহা বুঝান নাই। আপনি বলিয়াছেন যে, কামাদির অধিক স্ফুরণে, অন্যান্য বৃত্তি, যথা ভক্তি প্রীতি দয়া, এ সকলের উত্তম স্ফূর্ত্তি হয় না, এই জন্য অসামঞ্জস্য ঘটে। কিন্তু ভক্তি প্রীতি দয়াদির অধিক স্ফুরণেও কাম ক্রোধাদির উত্তম স্ফূর্ত্তি হয় না; ইহাতে অসাঞ্জস্য ঘটে না কেন?
গুরু। যেগুলি শারীরিক বৃত্তি বা পাশব বৃত্তি, যাহা পশুদিগেরও আছে এবং আমাদিগেরও আছে, সেগুলি জীবনরক্ষা বা বংশরক্ষা জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয়। ইহাতে সহজেই বুঝা যায়, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত-অনুশীলনসাপেক্ষ নহে। আমাদিগকে অনুশীলন করিয়া ক্ষুধা আনিতে হয় না, অনুশীলন করিয়া ঘুমাইবার শক্তি অর্জ্জন করিতে হয় না। দেখিও, স্বতঃস্ফূর্ত্তে ও সহজে গোল করিও না। যাহা আমাদের সঙ্গে জন্মিয়াছে, তাহা সহজ। সকল বৃত্তিই সহজ। কিন্তু সকল বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা অন্য বৃত্তির অনুশীলনে বিলুপ্ত হইতে পারে না।
শিষ্য। কিছুই বুঝিলাম না। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহাই বা অন্য বৃত্তির অনুশীলনে বিলুপ্ত হইবে কেন?
গুরু। অনুশীলন জন্য তিনটি সামগ্রী প্রয়োজনীয়। (১) সময়, (২) শক্তি (Energy), (৩) যাহা লইয়া বৃত্তির অনুশীলন করিব-অনুশীলনের উপাদান। এখন আমাদিগের সময় ও শক্তি উভয় সঙ্কীর্ণ। মনুষ্যজীবন কয়েক বৎসর মাত্র পরিমিত। জীবিকানির্ব্বাহের কার্য্যের পর বৃত্তির অনুশীলন জন্য যে সময় অবশিষ্ট থাকে, তাহার কিছুমাত্র অপব্যয় হইলে সকল বৃত্তির সমুচিত অনুশীলনের উপযোগী সময় পাওয়া যাইবে না। অপব্যয় না হয়, তাহার জন্য এই নিয়ম করিতে হয় যে, যে বৃত্তি অনুশীলনসাপেক্ষ নহে, অর্থাৎ স্বতস্ফুর্ত্ত, তাহার অনুশীলনের জন্য সময় দিব না; যাহা অনুশীলনসাপেক্ষ, তাহার অনুশীলনে সকল সময়টুকু দিব। যদি তাহা না করিয়া, স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির অনাবশ্যক অনুশীলনে সময় হরণ করি, তবে সময়াভাব অন্য বৃত্তিগুলির উপযুক্ত অনুশীলন হইবে না। কাজেই সে সকলের খর্ব্বতা বা বিলোপ ঘটিবে। দ্বিতীয়তঃ শক্তি সম্বন্ধেও ঐ কথা খাটে। আমাদের কাজ করিবার মোট যে শক্তিটুকু আছে, তাহাও পরিমিত। জীবিকানির্ব্বাহের পর যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির অনুশীলন জন্য বড় বেশী থাকে না। বিশেষ, পাশব বৃত্তির সমধিক অনুশীলন, শক্তিক্ষয়কারী। তৃতীয়তঃ, স্বতঃস্ফূর্ত্ত পাশব বৃত্তির অনুশীলনের উপাদান ও মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের উপাদান পরস্পর বড় বিরোধী।
যেখানে ওগুলি থাকে, সেখানে এগুলি থাকিতে পায় না।
বিলাসিনীমণ্ডলমধ্যবর্ত্তীর হৃদয়ে ঈশ্বরের বিকাশ অসম্ভব এবং ক্রুদ্ধ অস্ত্রধারীর নিকট ভিক্ষার্থীর সমাগম অসম্ভব। আর শেষ কথা এই যে, পাশব বৃত্তিগুলি শরীর ও জাতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলিয়া, পুরুষপরম্পরাগত স্ফূর্ত্তিজন্যই হউক, বা জীবরক্ষাভিলাষী ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই হউখ, এমন বলবতী যে, অনুশীলনে তাঁহার সমস্ত হৃদয় পরিব্যাপ্ত করে, আর কোন বৃত্তিরই স্থান হয় না। এইটি বিশেষ কথা।