উত্তরে দুর্যোধন বলিলেন, আমি অধ্যয়ন, বিধিপূর্বক দান, সসাগরা বসুন্ধরার শাসন, বিপক্ষগণের মস্তকোপরি অবস্থান, অন্য ভূপালের দুর্লভ দেবভোগ্য সুখসম্ভোগ, ও অত্যুৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য লাভ করিয়াছি, পরিশেষে ধর্মপরায়ণ ক্ষত্রিয়গণের প্রার্থনীয় সমরমৃত্যু প্রাপ্ত হইয়াছি। অতএব আমার তুল্য সৌভাগ্যশালী আর কে হইবে? এক্ষণে আমি ভ্রাতৃবর্গ ও বন্ধুবান্ধবগণের সহিত স্বর্গে চলিলাম, তোমরা শোকাকুলিতচিত্ত মৃতকল্প হইয়া এই পৃথিবীতে অবস্থান কর।”

এই উত্তর আশ্চর্য নহে। যে সর্বস্ব পণ করিয়া হারিয়াছে, সে যদি দুর্যোধনের মত দাম্ভিক হয়, তবে সে যে জয়ী শত্রুকে বলিবে, আমিই জিতিয়াছি, তোমরা হারিয়াছ, ইহা আশ্চর্য নহে। দুর্যোধন এইরূপ কথা হ্রদে থাকিয়াও বলিয়াছিল। যুদ্ধে মরিলে যে স্বর্গলাভ হয়, সকল ক্ষত্রিয়ই বলিত। উত্তর আশ্চর্য নহে, কিন্তু উত্তরের ফল সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য। এই কথা বলিবা মাত্র “আকাশ হইতে সুগন্ধি পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল। গন্ধর্বগণ সুমধুর বাদিত্রবাদন ও অপ্সরা সকল রাজা দুর্যোধনের যশোগান করিতে আরম্ভ করিলেন। সিদ্ধগণ তাঁহারে সাধুবাদ প্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন। সুগন্ধসম্পন্ন সুখস্পর্শ সমীরণ মন্দ মন্দ সঞ্চারিত হইতে লাগিল। দিঙ্‌মণ্ডল ও নভোমণ্ডল সুনির্মল হইল। তখন বাসুদেবপ্রমুখ পাণ্ডবগণ সেই দুর্যোধনের সম্মানসূচক অদ্ভুত ব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় লজ্জিত হইলেন। এবং তাঁহারা ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ভূরিশ্রবারে অধর্মযুদ্ধে বিনাশ করিয়াছেন, এই কথা শ্রবণ করিয়া শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন।”

যিনি মহাভারতের সর্ব পাপাত্মার অধম-পাপাত্মা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন, তাঁহার এরূপ অদ্ভুত সম্মান ও সাধুবাদ, আর যাঁহারা সকল ধর্মাত্মার শ্রেষ্ঠ ধর্মাত্মা বর্ণিত হইয়াছেন, তাঁহাদের এই অধর্মাচরণ জন্য লজ্জা, মহাভারতে আশ্চর্য। সিদ্ধগণ, অপ্সরাগণ, দেবগণ মিলিয়া প্রকটিত করিতেছেন, দুরাত্মা দুর্যোধন ধর্মাত্মা, আর কৃষ্ণপাণ্ডব মহাপাপিষ্ঠ। ইহা মহাভারতে আশ্চর্য, কেন না, ইহা সমস্ত মহাভারতের বিরোধী। সিদ্ধগণাদি দূরে থাক, কোন মনুষ্য দ্বারা এরূপ সাধুবাদ মহাভারতে আশ্চর্য বলিয়া বিবেচ্য, কেন না, মহাভারতের উদ্দেশ্যই দুর্যোধনের অধর্ম ও কৃষ্ণ পাণ্ডবদিগের ধর্ম কীর্তন। রসের উপর রসের কথা, তাঁহারা দুর্যোধন—মুখে শুনিলেন যে, তাঁহারা ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও ভূরিশ্রবাকে অধর্মযুদ্ধে বধ করিয়াছেন; অমনি শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এত কাল তাঁহারা কিছুই জানিতেন না, এখন পরম শত্রুর মুখে জানিয়া, ভদ্রলোকের মত, শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা জানিতেন যে, ভীষ্ম বা কর্ণকে তাঁহারা কোন প্রকার অধর্ম করিয়া মারেন নাই, কিন্তু পরম শত্রু দুর্যোধন বলিতেছে, তোমরা অধর্ম করিয়া মারিয়াছ, কাজেই তাহাতে অবশ্য বিশ্বাস করিলেন; অমনি শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা জানিতেন যে, ভূরিশ্রবাকে তাঁহারা কেহই বধ করেন নাই—সাত্যকি করিয়াছিলেন, সাত্যকিকে বরং কৃষ্ণ, অর্জুন ও ভীম নিষেধ করিয়াছিলেন, তথাপি যখন পরমশত্রু দুর্যোধন বলিতেছে, তোমরাই মারিয়াছ, আর তোমরাই অধর্মাচরণ করিয়াছ, তখন গোবেচারা পাণ্ডবেরা অবশ্য বিশ্বাস করিতে বাধ্য যে, তাঁহারাই মারিয়াছেন, এবং তাঁহারাই অধর্ম করিয়াছেন; কাজেই তাঁহারা ভদ্রলোকের মত কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন। এ ছাই ভস্ম মাথামুণ্ডের সমালোচনা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে এ হতভাগ্য দেশের লোকের বিশ্বাস যে, যাহা কিছু পুঁথির ভিতর পাওয়া যায়, তাহাই ঋষিবাক্য, অভ্রান্ত, শিরোধার্য। কাজেই এ বিড়ম্বনা স্বেচ্ছাপূর্বক আমাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে।