কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
আশ্চর্য কথাগুলো এখনও শেষ হয় নাই, কৃষ্ণ ত স্বকৃত অধর্মাচরণ জন্য লজ্জিত হইলেন, আবার সেই সময়ে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে পাণ্ডবদিগের কাছে সেই পাপাচরণ জন্য আত্মশ্লাঘা করিতে লাগিলেন।*
বলা বাহুল্য যে, দুর্যোধনকৃত তিরস্কারাদি বৃত্তান্ত সমস্তই অমৌলিক। দ্রোণবধাদি যে অমৌলিক, তাহা আমি পূর্বে প্রমাণীকৃত করিয়াছি। যাহা অমৌলিক, তাহার প্রসঙ্গ যে অংশে আছে, তাহাও অবশ্য অমৌলিক। কেবল এতটুকু বলা আবশ্যক যে, এখানে দ্বিতীয় স্তরের কবিরও লেখনীচিহ্ন দেখা যায় না। এ তৃতীয় স্তরের বলিয়া বোধ করা যায়। দ্বিতীয় স্তরের কবি কৃষ্ণভক্ত, এই লেখক কৃষ্ণদ্বেষক। শৈবাদি অবৈষ্ণব বা বৈষ্ণবদ্বেষিগণও স্থানে স্থানে মহাভারতের কলেবর বাড়াইয়াছেন, তাহা পূর্বে বলিয়াছি। তাঁহারা কেহ এখানে গ্রন্থকার ইহাই সম্ভব। আবার এ কাজ কৃষ্ণভক্তের, ইহাও অসম্ভব নহে। নিন্দাচ্ছলে স্তুতি করা ভারতবর্ষীয় কবিদের একটা বিদ্যার মধ্যে।# এ তাও হইতে পারে।
সে যাই হউক, ইহার পরেই আবার দেখিতে পাই যে, দুর্যোধন অশ্বত্থামার নিকট বলিতেছেন, “আমি অমিততেজা বাসুদেবের মাহাত্ম্য বিলক্ষণ অবগত আছি। তিনি আমারে ক্ষত্রিয়ধর্ম হইতে পরিভ্রষ্ট করেন নাই। অতএব আমার জন্য শোক করিবার প্রয়োজন কি?”
এমন বারোইয়ারি কাণ্ডের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া বিড়ম্বনা নয়?
* যথা, “ভীষ্মপ্রমুখ মহারথগণ ও রাজা দুর্যোধন অসাধারণ সমরবিশারদ ছিলেন, তোমরা কদাচ তাঁহাদিগকে ধর্মযুদ্ধে পরাজয় করিতে সমর্থ হইতে না। আমি কেবল তোমাদের হিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র হইয়া অনেক উপায় উদ্ভাবন ও মায়াবল প্রকাশপূর্বক তাঁহাদিগকে নিপাতিত করিয়াছি। আমি যদি ঐরূপ কুটিল ব্যবহার না করিতাম, তাহা হইলে তোমাদিগের জয়লাভ, রাজ্যলাভ ও অর্থলাভ কখনই হইত না। দেখ, ভীষ্ম প্রভৃতি সেই চারি মহাত্মা ভূমণ্ডলে অতিরথ বলিয়া প্রথিত আছেন। লোকপালগণ সমবেত হইয়াও তাঁহাদিগকে ধর্মযুদ্ধে নিহত করিতে সমর্থ হইতেন না। আর দেখ, সমরে অপরিশ্রান্ত গদাধরী এই দুর্যোধনকে দণ্ডধারী কৃত্তান্তও ধর্মযুদ্ধে বিনষ্ট করিতে পারেন না; অতএব ভীম যে উহারে অসৎ উপায় অবলম্বনপূর্বক নিপাতিত করিয়াছেন, সে কথা আর আন্দোলন করিবার আবশ্যক নাই। এইরূপ প্রসিদ্ধি আছে যে, শত্রুসংখ্যা বৃদ্ধি হইলে তাহাদিগকে কূট যুদ্ধে বিনাশ করিবে। মহাত্মা সুরগণ কূট যুদ্ধের অনুষ্ঠান করিয়াই অসুরগণকে নিহত করিয়াছিলেন; তাঁহাদের অনুকরণ করা সকলেরই কর্তব্য।” এমন নির্লজ্জ অধর্ম আর কোথাও শুনা যায় না।
# একটা উদাহরণ না দিলে, অনেক পাঠক বুঝিতে পারিবেন না; স্মর ভস্মীভূত হওয়ার পর বিলাপকালে রতির মুখে ভারতচন্দ্র বলিতেছেন,
# একটা উদাহরণ না দিলে, অনেক পাঠক বুঝিতে পারিবেন না; স্মর ভস্মীভূত হওয়ার পর বিলাপকালে রতির মুখে ভারতচন্দ্র বলিতেছেন,
“একের কপালে রহে, আরের কপাল দহে
আগুনের কপালে আগুন।”
ইহা আগুনকে গালি বটে, কিন্তু একটু ভাষান্তর করিলেই স্তুতি, যথা—
“হে অগ্নে! তুমি শম্ভুললাটবিহারী লোকধ্বংসকারী, তোমার শিখা জ্বালাবিশিষ্ট হউক।” পাঠক, ভারতচন্দ্রপ্রণীত অন্নদামঙ্গলে দক্ষকৃত শিবনিন্দা দেখিবেন। গ্রন্থের কলেবরবৃদ্ধিভয়ে তাহা উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না।