কৃষ্ণচরিত্র - পঞ্চম খণ্ড
“পাণ্ডবগণ, নিদ্রা, তন্দ্রা, ক্রোধ, হর্ষ, ক্ষুধা, পিপাসা, হিম, রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখে সন্তুষ্ট আছেন; সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্ন বীরগণ কদাচ অল্পে সন্তুষ্ট হয়েন না। বীরব্যক্তিরা হয় অতিশয় ক্লেশ, না হয় অত্যুৎকৃষ্ট সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকেন; আর ইন্দ্রিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।”
“রাজ্যলাভ বা বনবাস”* এ কথা ত আধুনিক হিন্দু বুঝে না। বুঝিলে, এত দুঃখ থাকিত না। যে দিন বুঝিবে, সে দিন আর দুঃখ থাকিবে না। হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কি না, মেম সাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মত কিচির মিচির করি।
কৃষ্ণ কুন্তীকে আরও বলিলেন, “আপনি তাহাদিগকে শত্রুবিনাশ করিয়া সকল লোকের আধিপত্য ও অতুল সম্পত্তি ভোগ করিতে দেখিবেন।”
অতএব কৃষ্ণ নিশ্চিত জানিতেন যে, সন্ধি হইবে না—যুদ্ধ হইবে। তথাপি সন্ধি স্থাপন জন্য হস্তিনায় আসিয়াছেন; কেন না, যে কর্ম অনুষ্ঠেয়, তাহা সিদ্ধ হউক বা না হউক, তাহার অনুষ্ঠান করিতে হয়, ফলাফলে অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য সাধন করিতে হয়। ইহাকেই তিনি গীতায় কর্মযোগ বলিয়া বুঝাইয়াছেন। যুদ্ধের অপেক্ষা সন্ধি মনুষ্যের হিতকর; এই জন্য সন্ধিস্থাপন অনুষ্ঠেয়। কিন্তু যখন যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া সন্ধিস্থাপন করিতে পারিলেন না, তখন কৃষ্ণই আবার যুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ অর্জুনের প্রধান উৎসাহদাতা ও সহায়। কেন না, যখন সন্ধি অসাধ্য তখন যুদ্ধই অনুষ্ঠেয় ধর্ম। অতএব যে কর্মযোগ তিনি গীতায় উপদিষ্ট করিয়াছেন, তিনি নিজেই তাহাতে প্রধান যোগী। তাঁহার আদর্শ চরিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনে আমরা প্রকৃত মনুষ্যত্ব কি, তাহা বুঝিতে পারিব বলিয়াই এত প্রয়াস পাইতেছি।
কৃষ্ণ, কুন্তীর নিকট হইতে বিদায় হইয়া পুনর্বার কৌরব-সভায় গমন করিলেন। সেখানে গেলে, দুর্যোধন তাঁহাকে ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন। তিনি তাহা গ্রহণ করিলেন না। দুর্যোধন ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। কৃষ্ণ প্রথমে তাঁহাকে লৌকিক নীতিটা স্মরণ করাইয়া দিলেন। বলিলেন, “দূতগণ কার্যসমাধানান্তে ভোজন ও পূজা গ্রহণ করিয়া থাকে; অতএব আমি কৃতকার্য হইলেই আপনার পূজা গ্রহণ করিব।” দুর্যোধন তবুও ছাড়ে না; আবার পীড়াপীড়ি করিল। তখন কৃষ্ণ বলিলেন,
“লোকে হয় প্রীতিপূর্বক অথবা বিপন্ন হইয়া অন্যের অন্ন ভোজন করে। আপনি প্রীতি সহকারে আমারে ভোজন করাইতে বাসনা করেন নাই; আমিও বিপদ্গ্রস্ত হই নাই, তবে কি নিমিত্ত আপনার অন্ন ভোজন করিব?”
* মিলটনের ক্ষুদ্রচেতা সয়তান্ বলিয়াছিল যে, স্বর্গে দাসত্বের অপেক্ষা বরং নরকে রাজত্ব শ্রেয়ঃ। আমি জানি যে, আমার এমন পাঠক অনেক আছেন, যাঁহারা এই ক্ষুদ্রোক্তির সঙ্গে উপরিলিখিত মহতী বাণীর কোন প্রভেদ দেখিবেন না। তাঁহাদিগের মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণরূপে আশাশূন্য লঘুচেতা, পরের প্রভুত্ব সহ্য করিতে পারে না। মহাত্মা, কর্তব্যানুরোধে তাহা পারেন, কিন্তু মহাত্মা জানেন যে, মহাদুঃখ বা মহাসুখ ব্যতীত, তাঁহার বহুবিস্তারাকাঙ্ক্ষিণী চিত্তবৃত্তি সকল স্ফূর্তিপ্রাপ্ত হইতে পারে না।