কৃষ্ণচরিত্র - পঞ্চম খণ্ড
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ—হস্তিনায় প্রথম দিবস
কৃষ্ণ আসিতেছেন শুনিয়া, যুদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তাঁহার অভ্যর্থনা ও সম্মানের জন্য বড় বেশী রকম উদ্যোগ আরম্ভ করিলেন। নানারত্নসমাকীর্ণ সভা সকল নির্মাণ করাইলেন, এবং তাঁহাকে উপঢৌকন দিবার জন্য অনেক হস্ত্যশ্বরথ, দাস, “অজাতাপত্য শতসংখ্যক দাসী,” মেষ, অশ্বতরী, মণিমাণিক্য ইত্যাদি সংগ্রহ করিতে লাগিলেন।
বিদুর দেখিয়া শুনিয়া বলিলেন, “ভাল, ভাল। তুমি যেমন ধার্মিক, তেমনই বুদ্ধিমান্। কিন্তু রত্নাদি দিয়া কৃষ্ণকে ঠকাইতে পারিবে না। তিনি যে জন্য আসিতেছেন, তাহা সম্পাদন কর; তাহা হইলেই তিনি সন্তুষ্ট হইবেন—অর্থপ্রলোভিত হইয়া তোমার বশ হইবেন না।”
ধৃতরাষ্ট্র ধূর্ত, এবং বিদুর সরল; দুর্যোধন দুই। তিনি বলিলেন, “কৃষ্ণ পূজনীয় বটে, কিন্তু তাঁহার পূজা করা হইবে না। যুদ্ধ ত ছাড়িব না; তবে তাঁর সমাদরে কাজ কি? লোকে মনে করিবে, আমরা ভয়েই বা তাঁহার খোশামোদ করিতেছি। আমি তদপেক্ষা সৎ পরামর্শ স্থির করিয়াছি। আমরা তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিব। পাণ্ডবের বল বুদ্ধি কৃষ্ণ, কৃষ্ণ আটক থাকিলে পাণ্ডবেরা আমার বশীভূত থাকিবে।”
এই কথা শুনিয়া ধৃতরাষ্ট্রও পুত্রকে তিরস্কার করিতে বাধ্য হইলেন। কেন না, কৃষ্ণ দূত হইয়া আসিতেছেন। কৃষ্ণভক্ত ভীষ্ম দুর্যোধনকে কতকগুলো কটূক্তি করিয়া সভা হইতে উঠিয়া গেলেন।
নাগরিকেরা, এবং কৌরবেরা বহু সম্মানের সহিত কৃষ্ণকে কুরুসভায় আনীত করিলেন। তাঁহার জন্য যে সকল সভা নির্মিত ও রত্নজাত রক্ষিত হইয়াছিল, তিনি তৎপ্রতি দৃষ্টিপাতও করিলেন না। তিনি ধৃতরাষ্ট্রভবনে গমন করিয়া কুরুসভায় উপবেশনপূর্বক, যে যেমন যোগ্য, তাহার সঙ্গে সেইরূপ সৎসম্ভাষণ করিলেন। পরে সেই রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করিয়া দীনবন্ধু এক দীনভবনে চলিলেন।
বিদুর, ধৃতরাষ্ট্রের এক রকম ভাই। উভয়েরই ব্যাসদেবের ঔরসে জন্ম। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র রাজা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ পুত্র; বিদুর তাহা নহে। তিনি, বিচিত্রবীর্যের দাসী এক বৈশ্যার গর্ভে জন্মিয়াছিলেন। তাঁহাকে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ ধরিলেও, তাঁহার জাতি নির্ণয় হয় না। কেন না, ব্রাহ্মণের ঔরসে, ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে, বৈশ্যার গর্ভে তাঁহার জন্ম।* তিনি সামান্য ব্যক্তি কিন্তু পরম ধার্মিক। কৃষ্ণ রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করিয়া তাঁহার বাড়ীতে গিয়া, তাঁহার নিকট আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। সেই জন্য, আজিও এ দেশে “বিদুরের খুদ,” এই বাক্য প্রচলিত আছে। পাণ্ডবমাতা কুন্তী, কৃষ্ণের পিতৃষ্বসা, সেইখানে বাস করিতেন। বনগমনকালে পাণ্ডবেরা তাঁহাকে সেইখানে রাখিয়াছিলেন। কৃষ্ণ কুন্তীকে প্রণাম করিতে গেলেন। কুন্তী পুত্রগণ ও পুত্রবধুর দুঃখের বিবরণ স্মরণ করিয়া কৃষ্ণের নিকট অনেক কাঁদাকাটা করিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ যাহা বলিলেন, তাহা অমূল্য। যে ব্যক্তি মনুষ্য-চরিত্রের সর্বপ্রদেশ সম্পূর্ণরূপে অবগত হইয়াছে, সে ভিন্ন আর কেহই সে কথার অমূল্যত্ব বুঝিবে না। মূর্খের ত কথাই নাই। শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন,
* মহাভারতীয় নায়কদিগের সকলেরই জাতি সম্বন্ধে এইরূপ গোলযোগ। পাণ্ডবদিগের সম্বন্ধে এইরূপ গোলযোগ। পাণ্ডবদিগের প্রপিতামহী, সত্যবতী, দাসকন্যা। ভীষ্মের মার জাতি লুকাইবার বোধ হয় বিশেষ প্রয়োজন ছিল, এজন্য তিনি গঙ্গানন্দন। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু ব্রাহ্মণের ঔরসে, ক্ষত্রিয়ার গর্ভজাত। ব্যাস নিজে সেই ধীবরনন্দিনীর কানীনপুত্র। অতএব পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্রের জাতি সম্বন্ধে এত গোলযোগ যে, এখনকার দিনে, তাঁহারা সর্বজাতির অপাংক্তেয় হইতেন। পাণ্ডুর পুত্রগণ, কুন্তীর গর্ভজাত বটে, কিন্তু বাপের বেটা নহেন; পাণ্ডু নিজে পুত্রোৎপাদনে অক্ষম। তাঁহারা ইন্দ্রাদির ঔরস পুত্র বলিয়া পরিচিত। এদিকে দ্রোণাচার্যের পিতা ভরদ্বাজ ঋষি, কিন্তু মা একটা কলসী; কলসীর গর্ভধারণ যাঁহাদের বিশ্বাস না হইবে, তাঁহারা দ্রোণের মাতৃকুল সম্বন্ধে বিশেষ সন্দিহান হইবেন। পাণ্ডবদিগের পিতা সম্বন্ধে যত গোলযোগ, কর্ণ সম্বন্ধেও তত-বেশীর ভাগ তিনি কানীন। দ্রৌপদী ও ধৃষ্টদ্যুম্নের বাপ মা কে, কেহ বলিতে পারে না; তাঁহারা যজ্ঞোদ্ভূত।
এ সময়ে কিন্তু, বিবাহ সম্বন্ধে কোন গোলযোগ ছিল না। অনুলোম প্রতিলোম বিবাহের কথা বলিতেছি না। অনেক ঋষির ধর্মপত্নীও ক্ষত্রিয়কন্যা ছিলেন; যথা, অগস্ত্যপত্নী লোপামুদ্রা, ঋষ্যশৃঙ্গের স্ত্রী শান্তা, ঋচীকভার্যা, জমদগ্নির ভার্যা (কেহ কেহ বলেন পরশুরামের ভার্যা) রেণুকা ইত্যাদি। এমনও কথা আছে যে, পরশুরাম পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য করিলে, ব্রাহ্মণদিগের ঔরসে পরবর্তী ক্ষত্রিয়েরা জন্মিয়াছিলেন। পক্ষান্তরে ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানী, ক্ষত্রিয় যযাতির ধর্মপত্নী। আহারাদি সম্বন্ধে কোন বাঁধাবাঁধি ছিল না, তাহাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, পরস্পরের অন্নভোজন করিতেন।