কৃষ্ণচরিত্র - পঞ্চম খণ্ড
ভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহণ একটা সামান্য কর্ম; কিন্তু আমাদের দৈনিক জীবন, সচরাচর কতকগুলা সামান্য কর্মের সমবায় মাত্র। সামান্য কর্মের জন্য একটা নীতি আছে অথবা থাকা উচিত। বৃহৎ কর্ম সকলের নীতির যে ভিত্তি, ক্ষুদ্র কর্ম সকলের নীতিরও সেই ভিত্তি। সে ভিত্তি ধর্ম। তবে উন্নতচরিত্র মনুষ্যের সঙ্গে ক্ষুদ্রচেতার এই প্রভেদ যে, ক্ষুদ্রচেতা ধর্মে পরাঙ্মুখ না হইলেও, সামান্য বিষয়ে নীতির অনুবর্তী হইতে সক্ষম হয়েন না, কেন না, নীতির ভিত্তি তিনি অনুসন্ধান করেন না। আদর্শ মনুষ্য এই ক্ষুদ্র বিষয়েও নীতির ভিত্তি অনুসন্ধান করিলেন। দেখিলেন যে, এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ সরলতা ও সত্যের বিরুদ্ধ হয়। অতএব দুর্যোধনকে সরল ও সত্য উত্তর দিলেন, স্পষ্ট কথা পরুষ হইলেও তাহা বলিতে সঙ্কুচিত হইলেন না। যেখানে অকপট ব্যবহার ধর্মানুমত হয়, সেখানেও তাহা পরুষ বলিয়া আমরা পরাঙ্মুখ। এই ধর্মবিরুদ্ধ লজ্জা অনেক সময়ে আমাদিগকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধর্মে বিপন্নও করে।
কৃষ্ণ তার পর কুরুসভা হইতে উঠিয়া বিদুরের ভবনে গমন করিলেন।
বিদুরের সঙ্গে রাত্রিতে তাঁহার অনেক কথোপকথন হইল। বিদুর তাঁহাকে বুঝাইলেন যে, তাঁহার হস্তিনায় আসা অনুচিত হইয়াছে; কেন না, দুর্যোধন কোন মতেই সন্ধি স্থাপন করিবে না। কৃষ্ণের উত্তর হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“যিনি অশ্বকুঞ্জররথসমবেত বিপর্যস্ত সমুদায় পৃথিবী মৃত্যুপাশ হইতে বিমুক্ত করিতে সমর্থ হন, তাহার উৎকৃষ্ট ধর্মলাভ হয়।”
ইউরোপের প্রতি রাজপ্রাসাদে এই কথাগুলি স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখা উচিত। সিমলার রাজপ্রাসাদেও বাদ পড়ে না। কৃষ্ণ পুনশ্চ বলিতেছেন,
“যে ব্যক্তি ব্যসনগ্রস্ত বান্ধব মুক্ত করিবার নিমিত্ত যথাসাধ্য যত্নবান্ না হন, পণ্ডিতগণ তাঁহারে নৃশংস বলিয়া কীর্তন করেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মিত্রের কেশ পর্যন্ত ধারণ করিয়া তাহাকে অকার্য হইতে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। * * * * যদি তিনি (দুর্যোধন) আমার হিতকর বাক্য শ্রবণ করিয়াও আমার প্রতি শঙ্কা করেন, তাহাতে আমার কিছু মাত্র ক্ষতি নাই; প্রত্যুত আত্মীয়কে সদুপদেশ প্রদান নিবন্ধন পরম সন্তোষ ও আনৃণ্য লাভ হইবে। যে ব্যক্তি জাতিভেদ সময়ে সৎপরামর্শ প্রদান না করে, সে ব্যক্তি কখনও আত্মীয় নহে।”
ইউরোপীয়দিগের বিশ্বাস, কৃষ্ণ কেবল পরস্ত্রীলুব্ধ পাপিষ্ঠ গোপ; এ দেশের লোকের কাহারও বা সেইরূপ বিশ্বাস, কাহারও বিশ্বাস যে, তিনি মনুষ্যহত্যার জন্য অবতীর্ণ, কাহারও বিশ্বাস, তিনি “চক্রী”—অর্থাৎ স্বাভিলাষসিদ্ধি জন্য কুচক্র উপস্থিত করেন। তিনি যে এ সকল নহেন—তিনি যে তৎপরিবর্তে লোকহিতৈষীর শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ, ধর্মোপদেষ্টার শ্রেষ্ঠ, আদর্শ মনুষ্য—ইহাই বুঝাইবার জন্য এই সকল উদ্ধৃত করিতেছি।