কৃষ্ণচরিত্র - প্রথম খণ্ড
এই সকল পণ্ডিতেরা বলেন যে, কেবল ললিতবিস্তরে, পাণ্ডবদিগের নাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সে পাণ্ডবেরা পার্বত্য দস্যু মাত্র। আমাদের বিবেচনা, তাহা হইতে এমন বুঝা যায় না যে, পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব পাঁচজন কখন জগতে বর্তমান ছিলেন না। বাঙ্গালা সাহিত্যে, “ফিরিঙ্গী” শব্দ যে দুই একখানা গ্রন্থে পাওয়া যায়, যে সকল গ্রন্থে ইহার অর্থ হয় “Eurasian”, নয় “European”—“Frank” শব্দ কোথাও পাওয়া যায় না, বা এ অর্থে “ফিরিঙ্গী” শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয় নাই। ইহা হইতে যদি আমরা সিদ্ধ করি যে, “Frank” জাতি কখন ছিল না, তাহা হইলে ইউরোপীয় পণ্ডিত ও তাঁহাদের শিষ্যগণ যে ভ্রমে পতিত হইয়াছেন, আমরাও সেই ভ্রমে পতিত হইব।*
এখনও লাসেন সাহেবের মতের সমালোচনা বাকি আছে। তিনি বলেন, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যাপার; মহাভারতের ততটুকু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু তিনি পাণ্ডব প্রভৃতি নায়কনায়িকাদিগের প্রতি অবিশ্বাসযুক্ত। তিনি বলেন, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যাপার; মহাভারতের ততটুকু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু তিনি পাণ্ডব প্রভৃতি নায়কনায়িকাদিগের প্রতি অবিশ্বাসযুক্ত। তিনি বলেন, অর্জুনাদি সব রূপকমাত্র। যথা—অর্জুন শব্দের অর্থ শ্বেতবর্ণ, এজন্য যাহা আলোকময়, তাহাই অর্জুন। যিনি অন্ধকার, তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণাও তদ্রূপ। পাণ্ডবদিগের অবস্থানকালে যিনি রাজ্যধারণ করিয়াছিলেন, তিনি ধৃতরাষ্ট্র। পঞ্চ পাণ্ডব পাঞ্চালের পাঁচটি জাতি, এবং পাঞ্চালীর সহিত তাঁহাদিগের বিবাহ ঐ পঞ্চ জাতির একীকরণ—সূচক মাত্র। যিনি ভদ্র অর্থাৎ মঙ্গল আনয়ন করেন, তিনি সুভদ্রা। অর্জুনের সঙ্গে যাদবদিগের সৌহার্দ্যই এই সুভদ্রা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
* “বৌদ্ধ-গ্রন্থকারেরা পাণ্ডব নামে পর্বতবাসী একটি জাতির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন; তাহারা উজ্জয়িনী ও কোশলবাসীদের শত্রু ছিল। (Weber’s H. I. Literature, 1878, p. 185.) মহাভারতে পাণ্ডবদিগকে হস্তিনাপুরবাসী বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে বটে, কিন্তু ঐ গ্রন্থেরও স্থলবিশেষে লিখিত আছে, প্রথমে তাঁহারা হিমালয় পর্বতে থাকিয়া পরিবর্ধিত হন।
এবং পাণ্ডোঃ সুতাঃ পঞ্চ দেবদত্তা মহাবলাঃ।* *
* * বিবর্ধমানাস্তে তত্র পুণ্যে হৈমবতে গিরৌ ||
আদিপর্ব। ১২৪। ২৭-২৯।
এইরূপে পাণ্ডুর দেব-দত্ত পাঁচটি মহাবল পুত্র * * * সেই পবিত্র হিমালয় পর্বতে পরিবর্ধিত হইতে থাকেন।
প্লিনি ও সলিনস্ নামে গ্রীক গ্রন্থকারেরা ভারতবর্ষের পশ্চিমোত্তর দিকে বাহ্ণীক দেশে উত্তরাংশে সোগ্ডিয়েনা দেশের একটি নগরের নাম পাণ্ড্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন এবং সিন্ধু নদীর মুখ সমীপস্থ জাতিবিশেষকেও পাণ্ড্য বলিয়া লিখিয়া গিয়াছেন। ভূগোলবিৎ টলেমি পাণ্ড্য-নাম লোকবিশেষকে বিতস্তা নদীর সমীপস্থ বলিয়া কীর্তন করিয়াছেন। কাত্যায়ন একটি পাণিনিসূত্রের বার্তিকে পাণ্ডু হইতে পাণ্ড্য শব্দ নিষ্পন্ন করিয়াছেন।# লক্ষ্মীধর স্বকৃত ষড়্ভাষাচন্দ্রিকার মধ্যে কেকয় বাহ্ণীকাদি উত্তরদিক্স্থ কতকগুলি জনপদের সহিত পাণ্ড্য দেশের নাম উল্লেখ করিয়াছেন এবং সে সমুদয়কে পিশাচ অর্থাৎ অসভ্য দেশবিশেষ বলিয়া কীর্তন করিয়া গিয়াছেন।
“পাণ্ড্যকেকয়বাহ্ণীক * * * এতে পৈশাচদেশাঃ স্যু।”
হরিবংশে দক্ষিণদিক্স্থ চোল কেরলাদির সহিত পাণ্ড্য দেশের নাম উল্লিখিত আছে। (হরিবংশ, ৩২ অ, ১২৪ শ্লো) অতএব উহা দক্ষিণাপথের অন্তর্গত পাণ্ড্য দেশ। শ্রীমান্ উইলসন্ বিবেচনা করেন; ঐ জাতীয় লোক প্রথমে সোগ্ডিয়েনা দেশের অধিবাসী ছিল; তথা হইতে ক্রমশঃ ভারতবর্ষে আসিয়া বাস করে এবং উত্তরোত্তর ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অধিবাস করিয়া পশ্চাৎ হস্তিনাপুর-বাসী হয়, ও অবশেষে দক্ষিণাপথে গিয়া পাণ্ড্যরাজ্য সংস্থাপন করে। Asiatic Researches, Vol. XV., pp. 95 and 96.
রাজতরঙ্গিণীর মতে, কাশ্মীর রাজ্যের প্রথম রাজারা কুরুবংশীয়। অতএব তৎপ্রদেশ হইতে পাণ্ডবদের হস্তিনায় আসিয়া উপনিবেশ করা সম্ভব। তাঁহারা মধ্যদেশবাসী অথচ কিরূপে পাণ্ডব বলিয়া পরিচিত হইলেন, এই সমস্যা পূরাণার্থেই কি পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব বলিয়া ক্রমশঃ একটি জনপ্রবাদ প্রচারিত হইল? তাঁহাদের জন্মবৃত্তান্তঘটিত গোলযোগ প্রসিদ্ধই আছে। লোকেও তাহাতে সংশয় প্রকাশ করিয়াছিল, তাহারও নিদর্শন পাওয়া যায়।
যদা চিরমৃতঃ পাণ্ডু কথং তস্যেতি চাপরে।
আদিপর্ব। ১। ১১৭।
অন্য অন্য লোকে বলিল, “বহুকাল অতীত হইল, পাণ্ডু প্রাণত্যাগ করিয়াছেন; অতএব ইঁহারা কিরূপে তদীয় পুত্র হইতে পারেন?”
ভারতবর্ষীয় উপাসকসম্প্রদায়, অক্ষয়কুমার দত্ত-প্রণীত, দ্বিতীয় ভাগ, উপক্রমণিকা, ১০৫ পৃঃ। অক্ষয় বাবু সচরাচর ইউরোপীয়-দিগের মতের অবলম্বী।
# পাণ্ডোর্ড্যণ্ বক্তব্যঃ—বার্তিক।