কৃষ্ণচরিত্র - প্রথম খণ্ড
প্রথম উদাহরণ স্বরূপ পূতনাবধবৃত্তান্ত দেওয়া যাউক।
ইহার প্রথমাবস্থা কোন গ্রন্থে নাই, কেবল অভিধানেই আছে, যেমন বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু। পরে দেখি, পূতনা, যথার্থতঃ সূতিকাগারস্থ শিশুর রোগ। কিন্তু পূতনা শকুনিকেও বলে; অতএব মহাভারতে পূতনা শকুনি। বিষ্ণুপুরাণে আর এক সোপান উঠিল; রূপকে পরিণত হইল। পূতনা “বালঘাতিনী” অর্থাৎ বালহত্যা যাহার ব্যবসায়; “অতিভীষণা”; তাহার কলেবর “মহৎ”; নন্দ দেখিয়া ত্রাসযুক্ত ও বিস্মিত হইলেন। তথাপি এখনও সে মানবী।* হরিবংশে দুইটা কথাই মিলান হইল। পূতনা মানবী বটে, কংসের ধাত্রী। কিন্তু সে কামরূপিণী পক্ষিণী হইয়া ব্রজে আসিল। রূপকত্ব আর নাই; এখন আখ্যান বা ইতিহাস; তৃতীয়াবস্থা এইখানে প্রথম প্রবেশ করিল। পরিশেষে ভাগবতে ইহার চূড়ান্ত হইল। পূতনা রোগও নয়, পক্ষিণীও নয়, মানবীও নহে। যে ঘোররূপা রাক্ষসী। তাহার শরীর ছয় ক্রোশ বিস্তৃত হইয়া পতিত হইয়াছিল, দাঁতগুলা এক একটা লাঙ্গল দণ্ডের মত, নাকের গর্ত গিরিকন্দরের তুল্য, স্তন দুইটা গণ্ডশৈল অর্থাৎ ছোট রকমের পাহাড়, চক্ষু অন্ধকূপের তুল্য, পেটটা জলশূন্য হ্রদের সমান, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা পীড়া ক্রমশঃ এত বড় রাক্ষসীতে পরিণত হইল, দেখিয়া পাঠক আনন্দ লাভ করিবেন আমরা ভরসা করি, কিন্তু মনে রাখেন যে, ইহা চতুর্থ অবস্থা।
ইহাতে পাই, অগ্রে মহাভারত; তারপর বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ; তারপর হরিবংশ; তারপর ভাগবত।
আর একটা উদাহরণ লইয়া দেখা যাউক। কাল শব্দের পর ইয় প্রত্যয় করিলে কালিয় শব্দ পাওয়া যায়। কালিয়ের নাম মহাভারতে নাই। বিষ্ণুপুরাণে কালিয়বৃত্তান্ত পাই। পড়িয়া জানিতে পারা যায় যে, ইহার কাল এং কালভয়নিবারণ কৃষ্ণপাদপদ্ম সম্বন্ধীয় একটি রূপক। সাপের একটি মাত্র ফণা থাকে, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে “মধ্যম ফণার” কথা আছে। মধ্যম বলিলে তিনটি বুঝায়। বুঝিলাম যে, ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানাভিমুখী কালিয়ের তিনটি ফণা। কিন্তু হরিবংশকার রূপকের প্রকৃত তাৎপর্য নাই বুঝিতে পারুন, বা তাহাতে নূতন অর্থ দিবার অভিপ্রায় রাখুন, তিনি দুইটি ফণা বাড়াইয়া দিলেন। ভাগবতকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন—একেবারে সহস্র ফণা করিয়া দিলেন।
এখন বলিতে পারি কি না যে, আগে মহাভারত, পরে বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ, পরে হরিবংশ, পরে ভাগবত।
এখন আর উদাহরণ বাড়াইবার প্রয়োজন নাই, কৃষ্ণচরিত্র লিখিতে লিখিতে অনেক উদাহরণ আপনি আসিয়া পড়িবে। স্থূল কথা এই যে, যে গ্রন্থে অমৌলিক, অনৈসর্গিক, উপন্যাসভাগ যত বাড়িয়াছে, সেই গ্রন্থ তত আধুনিক। এই নিয়মানুসারে, আলোচ্য গ্রন্থ সকলের পৌর্বাপর্য এইরূপ অবধারিত হয়।
প্রথম। মহাভারতের প্রথম স্তর।
দ্বিতীয়। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ।
তৃতীয়। হরিবংশ।
চতুর্থ। শ্রীমদ্ভাগবত।
ইহা ভিন্ন আর কোন গ্রন্থের ব্যবহার বিধেয় নহে। মহাভারতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর অমৌলিক বলিয়া অব্যবহার্য, কিন্তু তাহার অমৌলিকতা প্রমাণ করিবার জন্য, ঐ সকল অংশের কোথাও কোথাও সমালোচনা করিব। ব্রহ্মপুরাণ ব্যবহারের প্রয়োজন নাই, কেন না, বিষ্ণুপুরাণে যাহা আছে, ব্রহ্মপুরাণেও তাহা আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ পরিত্যাজ্য, কেন না, মৌলিক ব্রহ্মবৈবর্ত লোপপ্রাপ্ত হইয়াছে। তথাপি শ্রীরাধার বৃত্তান্ত জন্য একবার ব্রহ্মবৈবর্ত ব্যবহার করিতে হইবে। অন্যান্য পুরাণে কৃষ্ণকথা অতি সংক্ষিপ্ত, এজন্য সে সকলের ব্যবহার নিষ্ফল। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশ ভিন্ন চতুর্থাংশও কদাচিৎ ব্যবহার করার প্রয়োজন হইবে—যথা স্যমন্তক মণি, সত্যভামা, ও জাম্ববতীবৃত্তান্ত।
পুরাণ সকলের প্রক্ষিপ্তবিচার দুর্ঘট। মহাভারতে যে সকল লক্ষণ পাইয়াছি, তাহা হরিবংশে ও পুরাণে লক্ষ্য করা ভার। কিন্তু মহাভারত সম্বন্ধে আর যে দুইটা# নিয়ম করিয়াছি যে, যাহা অনৈসর্গিক, তাহা অনৈতিহাসিক ও অতিপ্রকৃত বলিয়া পরিত্যাগ করিব; আর যাহা নৈসর্গিক, তাহাও যদি মিথ্যার লক্ষণাক্রান্ত হয়, তবে তাহাও পরিত্যাগ করিব; এই দুইটি নিয়ম পুরাণ সম্বন্ধেও খাটিবে।
এক্ষণে আমরা কৃষ্ণচরিত্রকথনে প্রস্তুত।
* কোন অনুবাদকার অনুবাদে “রাক্ষসী” কথাটা বসাইয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণের মূলে এমন কথা নাই।
# ৪৬ পৃষ্ঠা দেখ।
# ৪৬ পৃষ্ঠা দেখ।