ইহাতে এই এক আপত্তি হইতে পারে যে, হিন্দুধর্ম্ম অহিন্দুর পক্ষে গ্রহণীয় নহে। যে কেহ ইহা করিলে খ্রীষ্টীয়, কি ইস্‌লাম ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া খ্রীষ্টীয়ান বা মুসলমান হইতে পারেন। কিন্তু যে হিন্দুকুলে জন্মগ্রহণ করে নাই—সে হিন্দুধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া হিন্দু হইয়া হিন্দুসমাজে মিশিতে পারে না। অতএব যে অনার্য্য আদৌ হিন্দুকুলজাত নহে, সে কখনও হিন্দু হইয়া হিন্দুসমাজে মিশিয়াছে, এ কথা কেহ বিশ্বাস করিবে না।

এই আপত্তি ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে বলবৎ বটে। কিন্তু এক একটি বৃহৎ জাতির পক্ষে ইহা খাটিতে পারে না। বিশেষতঃ বন্য অনার্য্য জাতিদিগের পক্ষে খাটিতে পারে না। মুসলমান বা খ্রীষ্টীয়ান কখনও হিন্দু হইতে পারে না; কেন না, যে সকল আচার হিন্দুত্ব ধ্বংসকারক, তাহারা পুরুষানুক্রমে সেই সকল আচার করিয়া পুরুষানুক্রমে পতিত। কিন্তু এ প্রদেশের বন্য অনার্য্য জাতিদিগের মধ্যে হিন্দুত্ববিনাশক এমন কোন আচার ব্যবহার নাই যে, তাহা হিন্দুদিগের অতি নিকৃষ্ট জাতিদিগের মধ্যে—হাড়ি ডোম মুচি কাওরা প্রভৃতির মধ্যে পাওয়া যায় না। মনে কর, যেখানে হিন্দু প্রবল, এমন কোন প্রদেশের সন্নিকটে অথবা হিন্দুদিগের অধীনে কোন অসভ্য অনার্য্য জাতি বাস করে। এমন স্থলে ইহা অবশ্যই ঘটিবে যে, আর্য্যেরা সমাজের বড়, অনার্য্যেরা সমাজের ছোট থাকিবে। মনুষ্যের স্বভাব এই যে, যে বড়, ছোট তাহার অনুকরণ করে। কাজে কাজেই এমত স্থলে অনার্য্যেরা হিন্দুদিগের সর্ব্বাঙ্গীণ অনুকরণে প্রবৃত্ত হইবে। আমরা এখন ইংরেজদিগের অনুকরণ করিতেছি, পূর্ব্বে মুসলমানদিগের অনুকরণ করিতাম। আমাদিগের একটি প্রাচীন ধর্ম্ম আছে, চারি হাজার বৎসর হইতে সেই ধর্ম্ম নানাবিধ কাব্য দর্শন ও উচ্চ নৈতিক তত্ত্বের দ্বারা অলঙ্কৃত হইয়া লোকমনোমোহন হইয়াছে, তাহার কাছে নিরাভরণ ইস্‌লাম বা খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম অনুরাগভাজন হয় না। এই জন্য আমরা এখন সর্ব্বথা ইংরেজদিগের অনুকরণ করিয়াও, ধর্ম্ম সম্বন্ধে তাহাদের ততটা অনুগমন করি না। কতকটা না করিতেছি, এমনও নহে। কিন্তু অনার্য্যদিগের মধ্যে তেমন উজ্জ্বল বা শোভাবিশিষ্ট কোন জাতীয় ধর্ম্ম নাই। অনেক স্থলে একেবারে কোন প্রকার জাতীয় ধর্ম্ম নাই। এমত অবস্থায় অধীন অনার্য্যসমাজ প্রভু আর্য্যদিগের অন্য বিষয়ে এমন অনুকরণ করিবে, ধর্ম্মসম্বন্ধেও সেইরূপ অনুকরণ করিবে। হিন্দুরা যে ঠাকুরের পূজা করে, তাহারাও সেই ঠাকুরের পূজা করিতে আরম্ভ করিতে আরম্ভ করিবে। হিন্দুরা যে সকল উৎসব করে, তাহারাও সেই সকল উৎসব করিতে আরম্ভ করিবে। জীবননির্ব্বাহের নিত্য নৈমিত্তিক কর্ম্ম সকলে হিন্দুদিগের ন্যায় আচার ব্যবহার করিতে থাকিবে। সমগ্র জাতি এইরূপ ব্যবহার করিতে থাকিলে কালক্রমে তাহারাও হিন্দু নাম ধারণ করিবে। অন্য হিন্দু কেহ কখন তাহাদিগের অন্ন খাইবে না। তাহাদিগের সহিত কন্যা আদান-প্রদান করিবে না, অথবা অন্য কোন প্রকারে তাহাদিগের সহিত মিশিবে না—হয় ত তাহাদিগের স্পৃষ্ট জল পর্য্যন্তও গ্রহণ করিবে না। অতএব তাহারাও একটি পৃথক্ হিন্দুজাতি বলিয়া গণ্য হইবে। তাহারা আগে যেমন পৃথক্ জাতি ছিল, এখনও তেমনি পৃথক্ জাতি রহিল, কেবল হিন্দুদিগের আচার ব্যবহারের অনুকরণ গ্রহণ করিয়া হিন্দুজাতি বলিয়া খ্যাত হইল। পাশ্চাত্ত্যদিগের মধ্যে একটি বিবাদের কথা আছে। কেহ কেহ বলেন যে, হিন্দু ধর্ম্ম “proselytizing” নহে, অর্থাৎ যে জন্মাবধি হিন্দু নয়, হিন্দুরা তাহাকে হিন্দু করে না। আর এক সম্প্রদায় বলেন যে, হিন্দু ধর্ম্ম proselytizing, অর্থাৎ অহিন্দুও হিন্দু হয়। এ বিবাদের স্থূলমর্ম্ম উপরে বুঝান গেল। খ্রীষ্টান বা মুসলমানদিগের proselytism এইরূপ যে, তাহারা অন্যকে ভজায়, “তুমি খ্রীষ্টান হও, তুমি মুসলমান হও।” আহূত ব্যক্তি খ্রীষ্টান বা মুসলমান হইলে তাহার সঙ্গে আহার ব্যবহার, কন্যা আদান প্রদান প্রভৃতি সামাজিক কার্য্য সকলেই করিয়া থাকে বা করিতে পারে। হিন্দুদিগের proselytization সেরূপ নহে। হিন্দুরা কাহাকেও ডাকে না যে, “তুমি স্বধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া আসিয়া হিন্দু হও।” যদি কেহ স্বেচ্ছাক্রমে হিন্দুধর্ম্ম গ্রহণ করে, তাহার সঙ্গে আহার ব্যবহার বা কোন প্রকার সামাজিক কার্য্য করে না, কিন্তু যে হিন্দুধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে, তাহার বংশে হিন্দুধর্ম্ম বজায় থাকিলে, তাহার হিন্দুনামও লোপ করিতে পারে না। একটা সম্পূ‍র্ণ জাতি এইরূপে হিন্দুধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া পুরুষানুক্রমে হিন্দুধর্ম্ম পালন করিলে, সকলেই তাহাকে হিন্দুজাতি বলিয়া স্বীকার করে। হিন্দুদিগের proselytism এই প্রকার। ঐ শব্দ মুসলমান বা খ্রীষ্টান সম্বন্ধে যে অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, হিন্দুদিগের সম্বন্ধে সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না। প্রকৃতপ্রস্তাবে হিন্দুদিগের মধ্যে proselytism নাই এবং তদর্থবাচক ভারতীয় কোন আর্য্যভাষায় কোন শব্দও নাই।