কথিত আছে যে, কোলেরা সবর নামক দ্রাবিড়ী অনার্য্যজাতি কর্ত্তৃক মগধ হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল। সবরেরা মনু ও মহাভারতে অনার্যজাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। সবর অদ্যাপি উড়িষ্যার নিকটবর্ত্তী প্রদেশে বর্ত্তমান আছে।
দ্রাবিড়ীয়গণ বাঙ্গালার উপান্তভাগ সকলে কোলবংশীয়দিগের অপেক্ষা বিরল। হাজারিবাগের ওঁরাও (ধাঙ্গর) ও রাজমহলের পাহাড়ীরা ভিন্ন আর কেহ নিকটে নাই। গোন্দেরা দ্রাবিড়ী বটে, কিন্তু তাহারা আমাদিগের নিকটবাসী নহে। কিন্তু বাঙ্গালার ভিতরেই এমন অনেক জাতি বাস করে যে, তাহারা দ্রাবিড়বংশীয় হইলে হইতে পারে। কর্ণেল্ ডাল্টন্ বলেন যে, কোচেরা অনগঙ্গবিজয়ী দ্রাবিড়ীগণ হইতে উৎপন্ন। বহুতর কোচ বাঙ্গালার ভিতরেই বাস করিতেছে। দিনাজপুর, মালদহ, রাজসাহী, রঙ্গপুর, বগুড়া, ঢাকা ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় কোচদিগকে পাওয়া যায়। বাঙ্গালার ভিতর প্রায় এক লক্ষ কোচের বাস আছে। এই লক্ষ লোককে বাঙ্গালী বলা যাইবে কি না?* কেহ কেহ বলেন, ইহাদিগকেও বাঙ্গালীর সামিল ধরিতে হইবে। আমরা সে বিষয়ে সন্দিহান। কোচেরা বাঙ্গালী হউক বা না হউক, বাঙ্গালার ভিতরে অনার্য্য আছে কি না, এ কথার আমাদিগের একবার আলোচনা করিয়া দেখা প্রয়োজন।
কে আর্য্য, কে অনার্য্য? ইহা নিরূপণ করিবার জন্য ভাষাতত্ত্বই প্রধান উপায়, ইহা দেখান গিয়াছে। যাহার ভাষা আর্য্যজাতীয় ভাষা, সেই আর্য্যবংশীয়। যাহার ভাষা অনার্য্যভাষা, সেই অনার্য্যজাতীয়, ইহা স্থির করা গিয়াছে। পরে দেখান গিয়াছে যে, যে অনার্য্যের ভাষা দ্রাবিড়জাতীয় ভাষা, সেই দ্রাবিড়বংশীয় অনার্য্য; যাহার কোলজাতীয়ভাষা, সেই কোলবংশীয় অনার্য্য | কিন্তু এমন কি হইতে পারে না যে, ভাষা একজাতীয়, বংশ অন্যজাতীয় একাধারে সমাবিষ্ট হইয়াছে? এমন কি হইতে পারে না যে, পরাজিত জাতি জেতৃগণের ধর্ম, জেতৃগণের ভাষা গ্রহণ করিয়া জেতৃদিগের জাতিভুক্ত হইয়াছে?
এমন উদাহরণ ইতিহাসে অনেক পাওয়া যায়। ফ্রান্সের বর্ত্তমান ভাষা লাটিন-মূলক, কিন্তু ফরাসি জাতির অস্থিমজ্জা কেল্টীয় শোণিতে নির্ম্মিত। প্রাচীন গলেরা রোমকগণ কর্ত্তৃক পরাজিত ও রোমকরাজ্যভুক্ত হইলে পর রোমীয় সভ্যতা গ্রহণ করে। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে রোমীয় ভাষা অর্থাৎ লাটিনভাষা গ্রহণ করে। যখন পশ্চিম রোমকসাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখন গল্দিগের মধ্যে লাটিনভাষাই প্রচলিত ছিল, পরে তাহারই অপভ্রংশে বর্ত্তমান ফরাসি ভাষা দাঁড়াইয়াছে। আইবিরিয়াতেও (স্পেন ও পর্টুগল্) ঐরূপ ঘটিয়াছিল। আমেরিকার কাফ্রি দাসদিগের বংশ প্রভুদিগের ভাষা অবলম্বন করিয়াছে, জাতীয় ভাষার পরিবর্ত্তে ইংরেজি বা ফরাসি ব্যবহার করিয়া থাকে।# অতএব ভাষা আর্য্যভাষা হইলেই আর্য্যবংশীয় বলা যাইতে পারে না—অন্য প্রমাণ আবশ্যক।
সকলেই জানে যে, আর্য্যেরা ককেশীয়বংশীয়। ককেশীয় বংশের মধ্যে আর্য্য ভিন্ন অন্য বংশও আছে, কিন্তু ককেশীয় বংশের অন্তর্গত নহে, এমন আর্য্যজাতি নাই। ককেশীয়দিগের লক্ষণ গৌরবর্ণ, দীর্ঘ শরীর, মস্তক সুগঠন, হনূদ্বয় অনুন্নত। মোঙ্গল বংশ ককেশীয়দিগের হইতে পৃথক্। মোঙ্গলীয়েরা খর্ব্বাকার, মস্তকের গঠন চতুষ্কোণ, হনূদ্বয় অত্যুন্নত। যদি কোন জাতিকে এমন পাওয়া যায় যে, তাহাদিগের শারীরিক গঠন মোঙ্গলীয়, তবে সে জাতিকে কখন আর্য্য বলা যাইবে না। যদি দেখিতে পাই, সে জাতীয়ের ভাষা আর্য্যভাষা, তাহা হইলে এইরূপ বিবেচনা করিতে হইবে যে, তাহারা আদৌ অনার্য্যজাতি, আর্য্যদিগের সহিত কোন প্রকার সম্বন্ধবিশিষ্ট হইয়া আর্য্যদিগের ভাষা গ্রহণ করিয়াছে। আবার যদি দেখি যে, সেই অনার্য্যজাতি কেবল আর্য্যভাষা নহে, আর্য্যধর্ম্ম পর্য্যন্ত গ্রহণ করিয়া আর্য্যসমাজভুক্ত হইয়াছে—তখন বুঝিতে হইবে যে, এক জাতি অপর জাতিকে বিজিত করিয়া একত্র বাস করায় একের সঙ্গে অন্য মিশিয়া গিয়াছে। যদি আবার দেখি যে, এই বিমিশ্র জাতিদ্বয়ের মধ্যে আর্য্য উন্নত—অনার্য্য অবনত, তবে বিবেচনা করিতে হইবে যে, আর্য্যেরা জয়কারী, অনার্য্যেরাই বিজিত হইয়া আর্য্যসমাজের নিম্ন স্তরে প্রবেশ করিয়াছে।
# ভারতবর্ষেও এই আর্য্য অনার্য্য জাতিদিগের মধ্যে আজিকার দিনেই আমাদিগের প্রত্যক্ষগোচরে এইরূপ ভাষাপরিবর্ত্তন ঘটিতেছে। এখনও অনেক স্থলে অনার্য্যেরা দিনে দিনে আপন মাতৃভাষা পরিত্যাগ করিয়া আর্য্যভাষা গ্রহণ করিতেছে। কর্ণেল্ ডাল্টন্ বলেন যে, তিনি ১৮৬৮ সালে কোড়বা জাতীয়গণের ভাষা সম্বন্ধে কতকগুলি তত্ত্বের অনুসন্ধান করিবার অভিপ্রায়ে কোড়বাদিগের বাসভূমি যশপুর রাজ্যে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার তলবমতে বহুসংখ্যক অসভ্য কোড়বা আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে কেহই কোড়বা ভাষার এক বর্ণও বলিতে পারিল না। তাহারা বলিল, তাহারা ডিহি কোড়বা—অর্থাৎ পার্ব্বত্য প্রদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সমতল প্রদেশে বাস করিয়া চাষ আবাদ করিতেছে। দেশ ও সমাজ পরিত্যাগের সঙ্গে ভাষাও ত্যাগ করিয়াছে। উদাহরণের স্বরূপ কর্ণেল্ ডাল্টন্ আরও বলেন যে, চুটীয়া নাগপুর প্রদেশে ওঁরাওদিগের যে সকল গ্রাম্য আছে, তাহার মধ্যে অনেক অনেক গ্রামের ওঁরাওয়েরা জাতীয় ভাষা বলিতে পারে না, হিন্দু বা মুণ্ডদিগের ভাষায় কথা কহে। Ethnology of Bengal, p. 115.





