দেবী চৌধুরাণী
হরবল্লভ এই পুণ্যময় অভিসন্ধিটা আপনার মনে মনেই রাখিলেন–ব্রজেশ্বরকে বিশ্বাস করিয়া বলিলেন না।
এদিকে সাগর আসিয়া ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে গিয়া গল্প করিল যে, ব্রজেশ্বর একটা রাজরাণীর বজরায় গিয়া, তাকে বিবাহ করিয়া আসিয়াছে, –সাগর অনেক মানা করিয়াছিল, তাহা শুনে নাই। মাগী জেতে কৈবর্ত–আর তার দুইটা বিবাহ আছে–সুতরাং ব্রজেশ্বরের জাতি গিয়াছে, সুতরাং সাগর আর ব্রজেশ্বরের পাত্রাবশিষ্ট ভোজন করিবে না, ইহা স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। ব্রহ্মঠাকুরাণী এ সকল কথা ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করায় অপরাধ স্বীকার করিয়া বলিল, “রাণীজি জাত্যংশে ভাল–আমার পিতৃঠাকুরের পিসী হয়। আর বিয়ে, –তা আমারও তিনটা, তারও তিনটা।”
ব্রহ্মঠাকুরাণী বুঝিল, কথাটা মিথ্যা; কিন্তু সাগরের মতলব যে, ব্রহ্মঠাকুরাণী এ গল্পটা নয়নতারার কাছে করে। সে বিষয়ে তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইল না। নয়নতারা একে সাগরকে দেখিয়া জ্বলিয়াছিল, আবার শুনিল যে, স্বামী একটা বুড়া কন্যে বিবাহ করিয়াছে। নয়নতারা একেবারে আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল। সুতরাং কিছুদিন ব্রজেশ্বর নয়নতারার কাছে ঘেঁষিতে পারিলেন না–সাগরের ইজারা-মহল হইয়া রহিলেন।
সাগরের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল। কিন্তু নয়নতারা বড় গোল বাধাইল–শেষে গিন্নীর কাছে গিয়া নালিশ করিল। গিন্নী বলিলেন, “তুমি বাছা, পাগল মেয়ে। বামনের ছেলে কি কৈবর্ত বিয়ে করে গা? তোমাকে সবাই ক্ষেপায়, তুমিও ক্ষেপ।”
নয়ান বৌ তবু বুঝিল না। বলিল, “যদি সত্য সত্যই বিয়ে হয়ে থাকে?” গিন্নী বলিলেন, “যদি সত্যই হয়, তবে বৌ বরণ করে ঘরে তুলবা। বেটার বৌ ত আর ফেলতে পারবি না।”
এই সময়ে ব্রজেশ্বর আসিল, নয়ান বৌ অবশ্য পলাইয়া গেল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “মা, কি বলছিলে গা?”
গিন্নী বলিলেন, “এই বলছিলাম যে, তুই যদি আবার বিয়ে করিস, তবে আবার বৌ বরণ করে ঘরে তুলি।”
ব্রজেশ্বর অন্যমনা হইল, কিছু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
প্রদোষকালে গিন্নী ঠাকুরাণী কর্তা মহাশয়কে বাতাস করিতে করিতে, ভর্তৃচরণে এই কথা নিবেদন করিলেন। কর্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার মনটা কি?”
গিন্নী। আমি ভাবি কি যে, সাগর বৌ ঘর করে না। নয়ান বৌ ছেলের যোগ্য বৌ নয়। তা যদি একটি ভাল দেখে ব্রজ বিয়ে করে সংসার-ধর্ম করে, আমার সুখ হয়।
কর্তা। তা ছেলের যদি সে রকম বোঝ, তা আমায় বলিও। আমি ঘটক ডেকে ভাল দেখে সম্বন্ধ করব।
গিন্নী। আচ্ছা, আমি মন বুঝিয়া দেখিব।
মন বুঝিবার ভার ব্রহ্মঠাকুরাণীর উপর পড়িল। ব্রহ্মঠাকুরাণী অনেক বিরহসন্তপ্ত এবং বিবাহ-প্রয়াসী রাজপুত্রের উপকথা ব্রজকে শুনাইলেন, কিন্তু ব্রজের মন তাহাতে কিছু বোঝা গেল না। তখন ব্রহ্মঠাকুরাণী স্পষ্ট জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন। কিছুই খবর পাইলেন না। ব্রজেশ্বর কেবল বলিল, “বাপ-মা যে আজ্ঞা করিবেন, আমি তাই পালন করিব।”
কথাটার আর বড় উচ্চবাচ্য হইল না।