দেবী চৌধুরাণী
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
যথাকালে পিতৃসমীপে উপস্থিত হইয়া ব্রজেশ্বর তাঁর পদবন্দনা করিলেন।
হরবল্লভ অন্যান্য কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, “আসল সংবাদ কি? টাকার কি হইয়াছে?”
ব্রজেশ্বর বলিলেন যে, “তাঁহার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই।” হরবল্লভের মাথায় বজ্রাঘাত হইল–হরবল্লভ চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে টাকা পাও নাই?”
“আমার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই বটে, কিন্তু আর এক স্থানে টাকা পাইয়াছি_”
হ। পেয়েছ? তা আমায় এতক্ষণ বল নাই? দুর্গা, বাঁচলাম।
ব্র। টাকাটা যে স্থানে পেয়েছি, তাহাতে সে গ্রহণ করা উচিত কি না, বলা যায় না।
হ। কে দিল?
ব্রজেশ্বর অধোবদনে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “তার নামটা মনে আসচে না–সেই যে মেয়ে ডাকাইত একজন আছে?”
হ। কে, দেবী চৌধুরাণী?
ব্র। সেই।
হ। তার কাছে টাকা পাইলে কি প্রকারে?
ব্রজেশ্বরের প্রাচীন নীতিশাস্ত্রে লেখে যে, এখানে বাপের কাছে ভাঁড়াভাঁড়িতে দোষ নাই। ব্রজ বলিল, “ও টাকাটা একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে।”
হ। বদ্ লোকের টাকা। লেখাপড়া কি রকম হইয়াছে?
ব্র। একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে বলিয়া লেখাপড়া করিতে হয় নাই।
বাপ আর এ বিষয়ে বেশী খোঁচাখুচি করিয়া জিজ্ঞাসা না করে, এ অভিপ্রায়ে ব্রজেশ্বর তখনই কথাটা চাপা দিয়া বলিল, “পাপের ধন যে গ্রহণ করে, সেও পাপের ভাগী হয়। তাই ও টাকাটা লওয়া আমার তেমন মত নয়।”
হরবল্লভ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “টাকা নেব না ত ফাটকে যাব না কি? টাকা ধার নেব, তার আবার পাপের টাকা পুণ্যের টাকা কি? আর জপতপের টাকাই বা কার কাছে পাব? সে আপত্তি করে কাজ নাই। কিন্তু আসল আপত্তি এই যে, ডাকাইতের টাকা, তাতে আবার লেখাপড়া করে নাই–ভয় হয়, পাছে দেরী হলে বাড়ী-ঘর লুঠপাট করিয়া লইয়া যায়।”
ব্রজেশ্বর চুপ করিয়া রহিল।
হ। তা টাকার মিয়াদ কত দিন?
ব্র। আগামী বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত।
হ। তা সে হোলো ডাকাইত। দেখা দেয় না। কোথা তার দেখা পাওয়া যাবে যে, টাকা পাঠাইয়া দিব?
ব্র। ঐ দিন সন্ধ্যার পর সে সন্ধানপুরে কালসাজির ঘাটে বজরায় থাকিবে। সেইখানে টাকা পৌঁছিলেই হইবে।
হরবল্লভ বলিলেন, “তা সেই দিন সেইখানেই টাকা পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে।”
ব্রজেশ্বর বিদায় লইলেন। হরবল্লভ তখন মনে মনে বুদ্ধি খাটাইয়া কথাটা ভাল করিয়া বিচার করিয়া দেখিলেন। শেষে স্থির করিলেন, “হাঁঃ, সেই বেটীর আবার টাকা শোধ দিতে যাবে! বেটীকে সিপাহী এনে ধরিয়ে দিলেই সব গোল মিটে যাবে। বৈশাখী সপ্তমীর দিন সন্ধ্যার পর কাপ্তেন সাহেব পল্টন তার বজরায় না উঠে–ত আমার নাম হরবল্লভই নয়। তাকে আর আমার কাছে টাকা নিতে হবে না।”