বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড - প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজনীতি
সর জর্জ কাম্বেল সাহেব “আত্মানুরূপ” ব্যক্তিকে স্বীয় মন্ত্রিত্বে বরণ করিয়াছেন বলিয়া দেশের লোক তাঁহার উপর রাগ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি বলিতে পারিতেন যে, নারদবাক্য আমার পক্ষে। আধুনিক ভারতীয় শাসনকর্ত্তাদিগের দূরদৃষ্ট এই যে, বৃদ্ধ মন্ত্রী তাঁহাদিগের কপালে প্রায় ঘটে না। কিন্তু ইউরোপে নারদীয় বাক্য প্রতিপালিত হইয়া থাকে—বিস্মার্ক, গ্লাডষ্টোন, ডিস্রেলি, টিয়র প্রভৃতি উদাহরণ। পরে,—
“একাকী বা বহুজনপরিবৃত হইয়া ত মন্ত্রণা করেন না? মন্ত্র ত জনপদমধ্যে অপ্রচলিত থাকে?”
ইংরেজেরা এই নীতির বশবর্ত্তী হইয়া কার্য্য করেন, কেবল অতিরিক্ত এই বলেন যে, “মন্ত্রণাবিশেষ জনপদমধ্যে প্রচার হওয়াই ভাল। অতএব সেইগুলি বাছিয়া বাছিয়া গেজেটে ছাপাই।“ পরে—
“স্বল্পায়াসসাধ্য মহোদয় বিষয় সকল ত শীঘ্রই সম্পন্ন করিয়া থাকেন?”
আমাদিগের অনুরোধ যে, প্রাচীন ঋষির এই বাক্য ইংরেজেরা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়া কার্য্যালয়ে প্রকটিত করুন। তৎপরে,—
“কৃষীবলেরা আপনার পরোক্ষে প্রকৃত ব্যবহার করিয়া থাকে? কারণ, প্রভুর প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ না থাকিলে এরূপ হওয়া নিতান্ত অসম্ভব সন্দেহ নাই।“
বিলাতী শাসনকর্ত্তা কিম্বা তাঁহাদিগের দেশী সমালোচক, কেহই অদ্যাপি এ কথার সারবত্তা অনুভূত করিতে সক্ষম হইলেন না। তৎপরে—
“অনারদ্ধ কার্য্যের পরীক্ষার্থ ধর্ম্মজ্ঞ শাস্ত্রকোবিদ বিচক্ষণ পরীক্ষকসকল ত নিযুক্ত করিয়া থাকেন?”
ইংরেজেরা এই কথার সম্যক্প্রকারে অনুবর্ত্তী। সকল কার্য্যের পূর্ব্বেই কমিটি নিযুক্ত হইয়া থাকে। সকল কার্য্য করিবার পূর্ব্বে ইংরেজেরা এক একটা কমিটি নিযুক্ত করেন কেন? এ কথা যিনি জিজ্ঞাসা করিবেন, তাঁহাকে দেয় উত্তর উল্লিখিত নারদবাক্যে আছে তৎপরে—
“সহস্র মূর্খ বিনিময় দ্বারা এক জন পণ্ডিতকে ত ক্রয় করিয়া থাকেন?”
আমরা এই কথাটির অনুমোদন করি না। মূর্খের দ্বারাই পৃথিবীর কার্য্য নির্ব্বাহ হইতেছে—পণ্ডিত কোন্ কাজে লাগে? মিল পার্লিয়ামেণ্টে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না—ওয়েষ্টমিনষ্টর কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইলেন। লাপ্লাসকে বোনাপার্টি পণ্ডিত দেখিয়া উচ্চ পদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন—কিন্তু লাপ্লাস কার্য্য সম্পাদনে অক্ষম হইয়া দূরীভূত হইলেন। প্রবাদ আছে, একজন ভট্টাচার্য্য বন্ধ্যা ভার্য্যার বিনিময়ে দুগ্ধবতী গো লইয়া আসিয়াছিলেন। সেইরূপ রাজপুরুষেরা অপ্রিয়বাদী, আত্মমতভক্ত, পণ্ডিতের বিনিময়ে আজ্ঞাকারী মূর্খই গ্রহণ করিয়া থাকেন। নারদ বলিয়াছেন বটে যে, “কোন প্রকার বিপদ্ উপস্থিত হইলে পণ্ডিত ব্যক্তি অনায়াসে তাহার প্রতিবিধান করিতে সমর্থ হয়েন |” এ কথা সত্য বটে, অতএব বিপদ্কালে পণ্ডিতের আশ্রয় লইবে। সুখের দিন মূর্খ;—দুঃখের দিনে পণ্ডিত।
পরে নারদ বলিতেছেন, “দুর্গসকল ত ধন ধান্য উদকযন্ত্রে পরিপূর্ণ রাখিয়াছেন। তথায় শিল্পীগণ ও ধনুর্দ্ধর পুরুষসকল ত সর্ব্বদা সতর্কতাপূর্ব্বক কালযাপন করে?”
মিউটিনির পূর্ব্বে ইংরেজেরা যদি এই কথা স্মরণ রাখিতেন, তবে তাদৃশ বিপদ্ ঘটিত না। সর হেনরি লরেন্স এই কথা বুঝিতেন বলিয়া লক্ষ্ণৌর রেসিডেন্সির রক্ষা হইয়াছিল।
“প্রচণ্ড দণ্ডবিধান দ্বারা প্রজাদিগকে ত অত্যন্ত উদ্বেজিত করেন না?”
ইউরোপীয়েরা অতি অল্পকাল হইল, এ কথা শিখিয়াছেন। এক পয়সা চুরির জন্য প্রাণদণ্ড প্রভৃতি প্রচণ্ড দণ্ড, অতি অল্পকাল হইল, ইংলণ্ড হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে।