বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড
প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজনীতি
নারদবাক্য
মহাভারতের সভাপর্ব্বে দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্নচ্ছলে কতকগুলি রাজনৈতিক উপদেশ দিয়াছেন। প্রাচীন ভারতে রাজনীতি কত দূর উন্নতি প্রাপ্ত হইয়াছিল, উহা তাহার পরিচয়। মুসলমানদিগের অপেক্ষা হিন্দুরা যে রাজনীতিতে বিজ্ঞতর ছিলেন, উহা পাঠ করিলে সংশয় থাকে না। প্রাচীন রোমক এবং আধুনিক ইউরোপীয়গণ ভিন্ন আর কোন জাতি তাদৃশ উন্নতি লাভ করিতে পারে নাই। ভারতবর্ষীয় রাজারা যে অন্যান্য সকল জাতির অপেক্ষা অধিক কাল আপনাদিগের গৌরব রক্ষা করিয়াছিলেন, এই রাজনীতিজ্ঞতা তাহার এক কারণ। হিন্দুদিগের ইতিবৃত্ত নাই; এক একটি শাসনকর্ত্তার গুণগান করিয়া শত শত পৃষ্ঠা লিখিবার উপায় নাই। কিন্তু তাঁহাদিগের কৃত কার্য্যের যে কিছু পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতেই অনেক কথা বলা যাইতে পারে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সহিত পৃথিবীর যে কোন রাজপুরুষের তুলনা করা যায়। চন্দ্রগুপ্ত আলেক্জণ্ডরের বিজিত ভারতাংশের পুনরুদ্ধার করিয়া, তক্ষশিলা হইতে তাম্রলিপ্তি পর্য্যন্ত সাম্রাজ্য সংস্থাপন করিয়া, মহতী কীর্ত্তি স্থাপিতা করিয়াছিলেন। ভুবনবিখ্যাত যবনরাজাধিরাজ সিলিউকসকে লাঘব স্বীকার করাইয়া তাঁহার কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। (হিন্দু হইয়া ঠিক বিবাহ করিয়াছিলেন, এমনও বোধ হয় না।) ইতিহাসে তিন জন সাম্রাজ্য-নির্ম্মাতা বিশেষ পরিচিতি—শার্লমান, দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক, প্রথম পিটর। আলেক্জণ্ডর, নাপোলিয়ন বা ক্রম্বেল সে শ্রেণীমধ্যে আসন পান নাই; কেন না, তাঁহাদের কীর্ত্তি তাঁহাদের মৃত্যু পর্য্যন্ত স্থায়ী বা তাহাও নহে। গজনবী মহম্মদের প্রায় সেইরূপ। আরবসাম্রাজ্য ও মোগলসাম্রাজ্য এক এক জনের নির্ম্মিত নহে। কিন্তু মগধসাম্রাজ্য একা চন্দ্রগুপ্তের নির্ম্মিত। এবং পুরুষানুক্রমে স্থায়ী বটে। তিনি শার্লমান, ফ্রেডেরিক ও পিটারের সঙ্গে উচ্চাসনে বসিতে পারেন।
নারদের যে উপদেশবাক্যের কথা উল্লেখ করিয়াছি, তাহাতে এমত তত্ত্ব অনেক আছে যে, রাজনীতিবিশারদ ইংরেজেরও তাহা গ্রহণ করিয়া তদনুসারে চলিলে, তাঁহাদিগের উপকার হয়। এমত কদাচ বক্তব্য নহে যে, হিন্দুরা এই সকল নৈতিক উক্তির অনুসারী হইয়া সর্ব্বত্র সর্ব্বপ্রকারে চলিতেন। কিন্তু ঈদৃশ নৈতিক তত্ত্ব যে তাঁহাদিগের দ্বারা উদ্ভুত হইয়াছিল, ইহা অল্প প্রশংসার কথা নহে। যেখানে উদ্ভুত হইয়াছিল, সেখানে যে উহা কিয়দংশ কার্য্যে পরিণত হইয়াছিল, তদ্বিষয়ে সংশয় করা অন্যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজনীতির কত দূর উন্নতি হইয়াছিল, তাহার কিঞ্চিৎ আলোচনা করিলে ক্ষতি নাই। এ জন্য আমরা উল্লিখিত নারদবাক্য হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিব। ঐ কথা পাঠকেরা অনেকেই পড়িয়াছেন, তথাপি উহার পুনঃপাঠে কষ্ট বোধ হইবে, এমন বিবেচনা হয় না।
নারদ জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “মহারাজ! কৃষি, বাণিজ্য, দুর্গসংস্কার, সেতুনির্ম্মাণ, আয়ব্যয় শ্রবণ, পৌরকার্য্য দর্শন ও জনপদ পর্য্যবেক্ষণ প্রভৃতি অষ্টবিধ রাজকার্য্য ত সম্যক্ প্রকারে সম্পাদিত হয়?*** নিঃশঙ্কচিত্ত কপট দূতগণ ত তোমার বা তোমার অমাত্যদিগের গূঢ় মন্ত্রণাসকল ভেদ করিতে পারে না? মিত্র উদাসীন ও শত্রুদিগের অভিসন্ধি সমস্ত আপনি ত বুঝিয়া থাকেন? যথাকালে সন্ধিস্থাপনে ও বিগ্রহবিধানে প্রবৃত্ত হয়েন? উদাসীন ও মধ্যমের প্রতি ও মাধ্যস্থ্য ভাব অবলম্বন করিয়া থাকেন? আত্মানুরূপ, বৃদ্ধ, বিশুদ্ধস্বভাব, সম্বোধনক্ষম, সৎকুলজাত, অনুরক্ত ব্যক্তিগণ মন্ত্রিপদে ত অভিষিক্ত হইয়া থাকেন?”