দেবী চৌধুরাণী
দেবী। তবে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটেই টাকা আনিবেন। সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত এখানে থাকিব। সপ্তমীর চন্দ্রাস্তের পর আসিলে আমার দেখা পাইবেন না।
ব্রজেশ্বর স্বীকৃত হইলেন। তখন দেবী পরিচারিকাদিগকে আজ্ঞা দিলেন, মোহরের ঘড়া ছিপে উঠাইয়া দিয়া আইসে। পরিচারিকারা ঘড়া ছিপে লইয়া গেল। ব্রজেশ্বরও দেবীকে আশীর্বাদ করিয়া ছিপে যাইতেছিলেন। তখন দেবী নিষেধ করিয়া বলিলেন, “আর একটা কথা বাকি আছে। এ ত কর্জ দিলাম–মর্যাদা দিলাম কই?”
ব্র। কলসীটা মর্যাদা।
দেবী। আপনার যোগ্য মর্যাদা নহে। যথাসাধ্য মর্যাদা রাখিব।
এই বলিয়া দেবী আপনার আঙ্গুল হইতে একটি আঙ্গটি খুলিল। ব্রজেশ্বর তাহা গ্রহণ করিবার জন্য সহাস্য বদনে হাত পাতিলেন। দেবী হাতের উপর আঙ্গটি ফেলিয়া দিল না–ব্রজেশ্বরের হাতখানি ধরিল–আপনি আঙ্গটি পরাইয়া দিবে।
ব্রজেশ্বর জিতেন্দ্রিয়, কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোলমাল হইয়া গেল, জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর তাহা বুঝিতে পারিল না। শরীরে কাঁটা দিল–ভিতরে যেন অমৃতস্রোত ছুটিল। জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর, হাতটা সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেল। বিধাতা এক এক সময়ে বাদ সাধেন যে, সময়ে আপন কাজ ভুলিয়া যাইতে হয়।
তা, দেবী সেই মানসিক গোলযোগের সময় ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে ধীরে ধীরে আঙ্গটি পরাইতে লাগিলেন। সেই সময়ে ফোঁটা দুই তপ্ত জল ব্রজেশ্বরের হাতের উপর পড়িল। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, দেবীর মুখ চোখের জলে ভাসিয়া যাইতেছে। কি রকমে কি হইল, বলিতে পারি না, ব্রজেশ্বর ত জিতেন্দ্রিয়–কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোল বাধিয়াছিল–সেই আর একখানা মুখ মনে পড়িল; এই সেই এই, কি এমনই একটা গোলমাল বাধিয়া গেল। ব্রজেশ্বর কিছু না বুঝিয়া–কেন জানি না–দেবীর কাঁধে হাত রাখিল, অপর হাতে ধরিয়া মুখখানি তুলিয়া ধরিল–বুঝি মুখখানা প্রফুল্লের মত দেখিল। বিবশ বিহ্বল হইয়া সেই অশ্রুনিষিক্ত বিম্বাধরে–আ ছি ছি! ব্রজেশ্বর! আবার!
তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কি করিলাম! এ কি প্রফুল্ল? সে যে দশ বৎসর মরিয়াছে! ব্রজেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিয়া একেবার ছিপে গিয়ে উঠিল। সাগরকে সঙ্গে লইয়াও গেল না। সাগর “ধর! ধর! আসামী পলায়!” বলিয়া, পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া ছিপে উঠিল। ছিপ খুলিয়া ব্রজেশ্বরকে ও ব্রজেশ্বরের দুই রত্নাধার–একটি সাগর আর একটি কলসী–ব্রজেশ্বরের নৌকায় পৌঁছাইয়া দিল।
এদিকে নিশি আসিয়া দেবীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দেবী নৌকার তক্তার উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতেছে। নিশি তাহাকে উঠাইয়া বসাইল–চোখের জল মুছাইয়া দিল– সুস্থির করিল। তখন নিশি বলিল, “এই কি মা, তোমার নিষ্কাম ধর্ম? এই কি সন্ন্যাস? ভগবদ্বাক্য কোথায় মা, এখন?”
দেবী চুপ করিয়া রহিল। নিশি বলিল, “ও সকল ব্রত মেয়েমানুষের নহে। যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মত হইতে হইবে। আমাকে কাঁদাইবার জন্য ব্রজেশ্বর নাই। আমার ব্রজেশ্বর বৈকুণ্ঠেশ্বর একই।”
দেবী চক্ষু মুছিয়া বলিল, “তুমি যমের বাড়ী যাও।”
নি। আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমার উপর যমের অধিকার নাই। তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।
দেবী। সে পথ খোলা থাকিলে আমি এ পথে আসিতাম না। এখন বজরা খুলিয়া দিতে। চার পাল উঠাও।
তখন সেই জাহাজের মত বজরা চারিখান তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল।