হেমচন্দ্র দেখিলেন, যবনেরা যুদ্ধ করিতেছে না, কেবল অপহরণ করিতেছে। যুদ্ধজন্য কেহই তাহাদিগের সম্মুখীন হয় নাই, সুতরাং যুদ্ধে তাহাদিগেরও মন ছিল না। যাহাদিগের অপহরণ করিতেছিল, তাহাদিগকেই অপহরণকালে বিনা যুদ্ধে মারিতেছিল। সুতরাং যবনেরা দলবদ্ধ হইয়া হেমচন্দ্রকে নষ্ট করিবার কোন উদ্যোগ করিল না। যে কোন যবন তৎকর্তৃক আক্রান্ত হইয়া তাঁহার সহিত একা যুদ্ধোদ্যম করিল, সে তৎক্ষণাৎ মরিল।

হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। তিনি যুদ্ধাকাঙ্ক্ষায় আসিয়াছিলেন, কিন্তু যবনেরা পূর্বেই বিজয়লাভ করিয়াছে, অর্থসংগ্রহ ত্যাগ করিয়া তাঁহার সহিত রীতিমত যুদ্ধ করিল না। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “একটি একটি করিয়া গাছের পাতা ছিঁড়িয়া কে অরণ্যকে নিষ্পত্র করিতে পারে? একটি একটি যবন মারিয়া কি করিব? যবন যুদ্ধ করিতেছে না-যবনবধেই বা কি সুখ? বরং গৃহীদের রক্ষার সাহায্যে মন দেওয়া ভাল |” হেমচন্দ্র তাহাই করিতে লাগিলেন, কিন্তু বিশেষ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। দুইজন যবন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করে, অপর যবনে সেই অবসরে গৃহস্থদিগের সর্বস্বান্ত করিয়া চলিয়া যায়। যাহাই হউক, হেমচন্দ্র যথাসাধ্য পীড়িতের উপকার করিতে লাগিলেন। পথপার্শ্বে এক কুটীরমধ্য হইতে হেমচন্দ্র আর্তনাদ শ্রবণ করিলেন। যবনকর্তৃক আক্রান্ত ব্যক্তির আর্তনাদ বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

দেখিলেন গৃহমধ্যে যবন নাই। কিন্তু গৃহমধ্যে যবনদৌরাত্ম্যের চিহ্ন সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। দ্রব্যাদি প্রায় কিছুই নাই, যাহা আছে তাহার ভগ্নাবস্থা, আর এক ব্রাহ্মণ আহত অবস্থায় ভূমে পড়িয়া আর্তনাদ করিতেছে। সে এ প্রকার গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে যে, মৃত্যু আসন্ন। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া সে যবনভ্রমে কহিতে লাগিল, “আইস-প্রহার কর-শীঘ্র মরিব-মার-আমার মাথা লইয়া সেই রাক্ষসীকে দিও-আ:-প্রাণ যায়-জল! জল! কে জল দিবে!”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার ঘরে জল আছে?”

ব্রাহ্মণ কাতরোক্তিতে কহিতে লাগিল, “জানি না-মনে হয় না-জল! জল! পিশাচী!-সেই পিশাচীর জন্য প্রাণ গেল!”

হেমচন্দ্র কুটীরমধ্যে অন্বেষণ করিয়া দেখিলেন, এক কলসে জল আছে। পাত্রাভাবে পত্রপুটে তাহাকে জলদান করিলেন।

ব্রাহ্মণ কহিল, না! না! জল খাইব না! যবনের জল খাইব না |” হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যবন নহি, আমি হিন্দু, আমার হাতের জল পান করিতে পার। আমার কথায় বুঝিতে পারিতেছ না?”

ব্রাহ্মণ জল পান করিল। হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার আর কি উপকার করিব?”

ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কি করিবে? আর কি? আমি মরি! মরি! যে মরে তাহার কি করিবে?”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার কেহ আছে? তাহাকে তোমার নিকট রাখিয়া যাইব?”

ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কে-কে আছে? ঢের আছে। তার মধ্যে সেই রাক্ষসী! সেই রাক্ষসী-তাহাকে বলিও-বলিও আমার অপ-অপরাধের প্রতিশোধ হইয়াছে |”

হে। কে সে? কাহাকে বলিব?

ব্রাহ্মণ কহিতে লাগিল, “কে সে পিশাচী! পিশাচী চেন না? পিশাচী মৃণালিনী-মৃণালিনী! মৃণালিনী-পিশাচী |”

ব্রাহ্মণ অধিকতর আর্তনাদ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নাম শুনিয়া চমকিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনী তোমার কে হয়?”

ব্রাহ্মণ কহিলেন, “মৃণালিনী কে হয়? কেহ না-আমার যম |”

হে। মৃণালিনী তোমার কি করিয়াছে?